সমস্ত লেখাগুলি

নাটক: চেন্নী -
অনুপ চক্রবর্তী
May 19, 2025 | নাটক | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

চরিত্র: প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা, জাস্টিস কৃষ্ণান, কারিয়াপ্পা, চেন্নী, শবরী, গিরিশ, পুরোহিত।

 (জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

কৃষ্ণান: বলুন কী ব্যাপার, প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা। আপনার টেলিফোনটা পেয়ে বেশ কৌতুহল হয়েছে আপনার সমাজনৃতত্ত্বের কাজের ব্যাপারে আমার মতামত আপনি চেয়েছেন দেখে। হ্যাঁ, কফি বলি? 

গুণ্ডাপ্পা: নো। থ্যাংকস। অন্য দিন তো দাবা খেলার ছলে আপনার চা-কফি ধ্বংস করি। কিন্তু আজ সেরকম মুডে নেই।

 কৃষ্ণান: কী ব্যাপার? 

গুণ্ডাপ্পা: ব্যাপারটা সমাজনৃতত্ত্বের হলেও, সমস্যাটা সম্পূর্ণ আমার নিজেকে নিয়ে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। আর আমার এই ব্যক্তিগত ব্যাপারে মতামত চাইতে এসেছি কিন্তু একজন বিচারকের কাছে। জাস্টিস কৃষ্ণান, আপনি বিচারক। আপনার আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আপনি আপনার মতামত বলবেন। এটা আমার খুব প্রয়োজন। 

কৃষ্ণান: ইন্টারেস্টিং! ব্যাপারটা কী? 

গুণ্ডাপ্পা: বলছি, জাস্টিস কৃষ্ণান। তার আগে ইফ ইউ পারমিট, আমি একটা সিগারেট ধরাবো।

 কৃষ্ণান: হাঃ হাঃ হাঃ হা। আজ কী ব্যাপার? স্মোক করতে আপনাকে নিষেধ করি স্বাস্থ্যের কারণে। বিচারকের দৃষ্টিতে নয়। 

গুণ্ডাপ্পা: জানি। তবু আজ আপনি আমার কাছে শুধুই একজন বিচারক। আপনার এই ড্রয়িরুম আজ আমার কাছে কার্যত একটা বিচার কক্ষ। (একটুক্ষণ চুপ করে থেকে) অথচ আমিও আজ কিছুটা টেন্স্ড।

 কৃষ্ণান: বুঝছি। আপনি আজ খুব ইন্টারেস্টিং কথা বলছেন প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা। নিন। শুরু করুন। টেনশন ছাড়ুন। আপনার লেখালেখিতে সব সময় একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাই। মনে হচ্ছে সেরকম কিছু ব্যাপার। তাই আমিও শুনতে উদগ্রীব। কেননা আমি আপনার একজন অনুরাগী পাঠক।

 গুণ্ডাপ্পা: গত সপ্তাহে আমি একটা কাজে এই জেলারই নাগবল্লী নামের একটা গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে গেছিলাম। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে হবে। ওই পঞ্চায়েতের অধীনের গ্রামগুলোতে কিছু বিরল পদবীর মানুষ আছে। সেইসব পদবী সংগ্রহ করা, তাদের উৎপত্তি, বিকাশ, সেই সব মানুষদের উপভাষা অর্থাৎ ডায়ালেক্ট ইত্যাদির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যেই গেছিলাম। আমার কাজ তো ভাষার আঁকবাঁক নিয়ে। 

কৃষ্ণান: হ্যাঁ। ভাষাবিজ্ঞানীর কাজটা অনেকটা প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো। তাইতো প্রফেসর? 

গুণ্ডাপ্পা: অনেক সময়। সে থাক। সেদিন একটি রাতের জন্যে আমাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ওই গ্রামেরই একটি লোকের বাড়িতে। বাধ্য হয়েই আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কারণ সন্ধের আগেই উঠল প্রচন্ড ঝড়। সঙ্গে বজ্রপাত আর প্রবল বৃষ্টি। অবিশ্রান্ত। সন্ধে গড়িয়ে রাত নামল। বৃষ্টি আর ঝড়ের থামার কোন লক্ষণ নেই। ভয়ানক দুর্যোগ। সেবার নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ড্রাইভার ছিল না। আজকাল রাত্রে দৃষ্টির একটু সমস্যা হচ্ছে। একটু চিন্তায় পড়ে ছিলাম কিভাবে ফিরব ভেবে। সমস্যার সমাধান করল একটি লোক। পঞ্চায়েত সদস্য। নাম অর্জুন কারিয়াপ্পা। আমার অসহায় অবস্থা দেখে লোকটা একটা রাতের জন্যে ওর বাড়িতে সাদর আমন্ত্রণ করল। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। পেলাম আন্তরিক ব্যবহার, সুন্দর আতিথেয়তা, আকণ্ঠ ভোজন। জাস্টিস কৃষ্ণান, আমি ভাষার গবেষক। দলিত সম্প্রদায়ের উপভাষার ওপর অনেক কাজ করেছি, করছিও। কিন্তু সেদিন বুঝলাম এই বিচিত্র দেশের সমাজকে কতটুকুই বা জানি। কিছুই না। এত বিচিত্র এই দেশ। এত রীতি, প্রথা,বিশ্বাস, সংস্কার…… সেটা ছিল ঝড়ের রাত….. (নীরবতা) 


(প্রথম ফ্ল্যাশব্যাক)

(কারিয়াপ্পার বাড়ি)

কারিয়াপ্পা: আসুন, বাবুজী। আসুন। গরীবের ঘরে আপনার মতো ব্রাহ্মণ মানুষের পায়ের ধুলো পড়ল। কী ভাগ্যি আমাদের। আমরা ধন্য হয়ে গেলাম বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: এসব কেন বলছ, কারিয়াপ্পা? এই প্রচন্ড দুর্যোগের রাতে আমার গাড়ি চালিয়ে ফেরা সম্ভব ছিল না। তুমি আমাকে আশ্রয় না দিলে আমি খুবই বিপদে পড়ে যেতাম। তোমার আমন্ত্রণের জন্যে বরং তোমাকেই আমার অনেক ধন্যবাদ জানানো উচিত।

কারিয়াপ্পা: একি বলছেন, বাবুজী!  আশ্রয় কি বলছেন! আপনি ব্রাহ্মণ অতিথি। দেবতা। আমাদের সত্যিই পরম সৌভাগ্য যে আজ আপনি আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়েছেন। 

 গুন্ডাপ্পা: দ্যাখো কারিয়াপ্পা, এসব ব্রাহ্মণ দেবতা এরকম সব কথা বলবে না। আমি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। মানুষকে কেন দেবতা বলছ? এরকম বলা ঠিক নয়।

কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। আপনি ব্রাহ্মণ। আর ব্রাহ্মণ হলেন দেবতা। আমরা তাই মনে করি।  আপনি দয়া করে রাগ করবেন না। 

গুন্ডাপ্পা: না না। রাগ করছি না। বলছি আমি ওসব মানি না। মানে মানুষকে দেবতা মনে করি না। মানুষ মানুষই। দেবতা দেবতাই। যে যার জায়গায় আছে। মানুষকে দেবতা বানানো ঠিক নয়। 

 কারিয়াপ্পা: না না বাবুজী। আপনি যতই বলুন আমরা তাই মনে করি। দয়া করে রাগ করবেন না। 

গুন্ডাপ্পা: আঃ কী মুশকিল! রাগ করার কথা উঠছে না। 

(কারিয়াপ্পা ওর স্ত্রী শবরীকে ডাকে)

কারিয়াপ্পা: কই গো শবরী, এসো। 

(শবরী ভেতর থেকে আসে মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে) 

 কারিয়াপ্পা: বাবুজী এসেছেন। ব্রাহ্মণ অতিথি মানুষ। দেব্তা। প্রণাম করো।

(শবরী ভূমিষ্ঠ হয়ে গুণ্ডাপ্পার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে যায়)

গুন্ডাপ্পা: আহাহাহা! একি করছেন! থাক। থাক।

 কারিয়াপ্পা: না না বাবুজী। প্রণাম ফিরিয়ে দেবেন না। আর শবরীকে আপনি বলবেন না। ও খুব লজ্জা পাবে।

 গুন্ডাপ্পা: আচ্ছা। ঠিক আছে। 

গুন্ডাপ্পা: আর আমাকেও আপনারএকটু পায়ের ধুলো নিতে দিন। 

গুন্ডাপ্পা: না-না-না-না- 

(আপত্তি সত্ত্বেও স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই গুন্ডাপ্পার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে) 

 গুন্ডাপ্পা: দ্যাখো কারিয়াপ্পা আমি শুধুই একজন শিক্ষক মানুষ। কিছু গবেষণার কাজে এ গ্রামে এসেছিলাম। বিপদের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। বিপদের সময়ে তোমাদের সুন্দর আতিথ্যে আমি মুগ্ধ ও ভীষণ উপকৃত। এটাই যথেষ্ট। কিন্তু তোমরাএভাবে আমাকে দেবতা বলে আর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে আমি বিব্রত বোধ করি। আমি পছন্দ করছি না এ সব। আমার শিক্ষাদীক্ষা একটু অন্যরকম। 

শবরী: বাবুজী, রাগ করবেন না। আপনি সত্যিই আমাদের দেব্তা। কারণ আপনি ব্রাহ্মণ। আমার স্বামী ঠিকই বলেছেন। আপনাকে সেবা করে আমাদের পুণ্য করতে দিন। 

 গুন্ডাপ্পা: আবার এসব কী বলছ? সেবা, পুণ্য এসব বলবে না। আমি ঠিক এরকম করে ভাবি না। 

 কারিয়াপ্পা: যাও। যাও। বাবুজীর হাত পা ধোয়ার জন্যে জলের বালতি, মগ, গামলা নিয়ে এসো। 

শবরী: হ্যাঁ। হ্যাঁ। যাচ্ছি।

(শবরী ভেতরে চলে যায়)

 গুন্ডাপ্পা: এখানে কেন? তোমাদের স্নানের ঘর নেই? 

 কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। আমরা বাড়ির পেছনে পুকুরে হাত পা ধুই, চান করি। 

 গুন্ডাপ্পা: তাহলে আমাকে পুকুরটা দেখিয়ে দাও। আমি যাই। হাত,পা ধুয়ে আসি। 

কারিয়াপ্পা: এখন তো ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় হচ্ছে। কী করে যাবেন?

 গুন্ডাপ্পা: তাইতো। মুশকিল হল। তাহলে কী হবে?

কারিয়াপ্পা: আপনি কিছু ভাববেন না, বাবুজী। এখানেই হাত,পা ধোবেন। কোন অসুবিধা হবে না।

(ইতিমধ্যে শবরী জলের বালতি, গামলা, মগ নিয়ে আসে)

শবরী: বাবুজী, আপনার পাদুটো এই গামলাতে রাখুন। 

 গুন্ডাপ্পা: (খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়) এই গামলায় পা ধোবো? ঘর নোংরা হয়ে যাবে তো জল ছিটকে পড়লে।

 কারিয়াপ্পা: কোন অসুবিধা হবে না, বাবুজী। শবরী ঘর মুছে দেবে। 

(গুন্ডাপ্পা খুব ইতস্তত করে গামলায় পা দুটো রাখেন। শবরী মগে করে জল ঢালতে থাকে গুন্ডাপ্পার পায়ে)

 গুন্ডাপ্পা: (বিব্রত হয়ে) একি করছ? আমাকে মগটা দাও। আমি ঢালছি।

 শবরী: কোন অসুবিধা নেই, বাবুজী। ব্যস্ত হবেন না। এবার পা দুটো গামলা থেকে তুলে নিন।

(গুণ্ডাপ্পা পা দুটো গামলা থেকে তুলে নেয়। শর্বরী খোঁপা খুলে ওর চুল দিয়ে গুণ্ডাপ্পার পা মুছিয়ে দিতে যায়। গুণ্ডাপ্পা দ্রুত সরে যান।)

 গুন্ডাপ্পা: একি বাড়াবাড়ি করছ? ছি ছি। আমার খুব খারাপ লাগছে। এখানে না এসে বরং ঝড়ের মধ্যে ফিরে গেলে ভালো হতো।

 শবরী: বাবুজী, এমনকরে বলবেন না। আমাদের ভয়ানক পাপ হবে। (শবরী ডুকরে কাঁদে) বলবেন না বাবুজী। আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ। আপনি দেব্তা। আপনি রাগ করলে আমাদের ভীষণ পাপ হবে। 

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ,বাবুজী। আপনি রাগ করলে আমাদের ভীষণ পাপ হবে।

 গুন্ডাপ্পা: তোমরা সব আশ্চর্য মানুষ। আশ্চর্য তোমাদের এরকম বিশ্বাস। আমি একটা বাইরের লোক। অতিথি যদিও, তবুও তোমার স্ত্রী আমার পা ধুয়ে দিচ্ছে, মাথার চুল দিয়ে পা মুছে দিতে যাচ্ছে, - এসব একদম ভালো লাগছে না। কী করে বোঝাবো তোমাদের যে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি চলে যাব এখান থেকে। হ্যাঁ, চলে যাব। ঝড়ের মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাব। তোমরা শোনো। আমি চলে যাচ্ছি।

(গুন্ডাপ্পা চলে যেতে উদ্যত হয়। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই দৌড়ে গিয়ে গুন্ডাপ্পার পা চেপে ধরে)

 কারিয়াপ্পা: দয়া করুন, বাবুজী। দয়া করুন। এভাবে চলে যাবেন না।

 শবরী: আপনি এভাবে চলে গেলে আমাদের ভীষণ অকল্যাণ হবে। 

কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ। শেষ হয়ে যাবো আমরা। আপনি না মানতে পারেন। আমরা তো মানি। আমরা তো বিশ্বাস করি।

গুন্ডাপ্পা: কী বিশ্বাস করো?

কারিয়াপ্পা:  আপনি দেবতা। ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হলেন দেবতা। 

 গুন্ডাপ্পা: তোমাদের বিশ্বাস নিয়ে তোমরা থাকো। আমি চলে যাচ্ছি। পা ছাড়ো।

 কারিয়াপ্পা: না। না। যাবেন না। বাইরে ভয়ানক দুর্যোগ হচ্ছে। ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। আপনার ক্ষতি হয়ে গেলে আমরা অপরাধী হয়ে যাব। 

শবরী: ভীষণ পাপ হবে আমাদের। 

(স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই কাঁদে)

 গুন্ডাপ্পা: (নরম হয়ে) আচ্ছা। আচ্ছা। ঠিক আছে কান্নাকাটি করার দরকার নেই। আমি যাচ্ছি না। তবে এসব বোলো না।  

 কারিয়াপ্পা: বাবুজী, আপনি চৌকিতে এই আসনে বসে খেয়ে নিন। অনেক রাত হয়ে গেছে। (চৌকিতে আসন পেতে দেয়। গুন্ডাপ্পা আসনে বসে।)

কারিয়াপ্পা: যাও। যাও। বাবুজির জন্যে খাবার নিয়ে এসো।

শবরী: হ্যাঁ যাচ্ছি। (ভেতরে চলে যায়) 

গুন্ডাপ্পা: তোমার পরিবারে আর কে কে আছে? 

কারিয়াপ্পা: (মাটিতে বসে)আমাদের এক মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়ে বড়। ছেলে ছোট।

 গুন্ডাপ্পা: আচ্ছা। লেখাপড়া করে তো?

কারিয়াপ্পা: ছেলেটা লেখাপড়া করে।

 গুন্ডাপ্পা: মেয়ে পড়াশোনা করে না?

 কারিয়াপ্পা: না।

 গুন্ডাপ্পা: কেন?

 কারিয়াপ্পা: বাবুজী, আমাদের জাতের মেয়েরা পড়াশোনা করে না।

গুন্ডাপ্পা: (আশ্চর্য হয়ে) কেন?

কারিয়াপ্পা: বাবুজী, আমাদের জাতের মেয়েরা পড়াশোনা করলে পরিবারের অকল্যাণ হয়। তাই করে না।

 গুন্ডাপ্পা: (প্রচণ্ড আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হয়ে) এ আবার কী কথা?

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ, বাবুজী। আমাদের জাতের মেয়েদের লেখাপড়া করতে নেই। মেয়েরা লেখাপড়া করে না আমাদের জাতে। 

 গুন্ডাপ্পা: আশ্চর্য! এমন অদ্ভুত কথা শুনতে হবে এই যুগে আমি ভাবতে পারিনি। এই গ্রামেতে তোমাদের জাতের কোন পরিবারের কোন মেয়ে কি তাহলে পড়াশোনা করে না?

 কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: আশ্চর্য। এই গ্রামে কি তাহলে মেয়েদের কোন স্কুল নেই? 

 কারিয়াপ্পা: না, বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: তুমি পঞ্চায়েতে আছ। তুমি কেন উদ্যোগ নাও নি মেয়েদের স্কুল খোলার জন্যে? আর তুমি কী করেই বা উদ্যোগ নেবে? তুমি তো নিজেই বলছ তোমাদের জাতে মেয়েদের পড়লে অকল্যাণ হয়। ছেলেমেয়েদের ডাকো। ওদের সঙ্গে আলাপ করি।

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। গিরিশ! চেন্নী! এখানে আয়।

(ছেলেমেয়ে দুটো আসে)

 কারিয়াপ্পা: বাবুজিকে প্রণাম কর। 

(ওরা প্রণাম করে) 

গুন্ডাপ্পা: থাক থাক। তোমার নাম গিরিশ? কোন ক্লাসে পড়?

গিরিশ: ক্লাস টেন এ।

গুন্ডাপ্পা: আর তুমি চেন্নী?

(চেন্নী মাথা নাড়ে)  

গুন্ডাপ্পা: এর চোখে মুখে যথেষ্ট বুদ্ধির ছাপ। অথচ একে লেখাপড়া শেখালে না! আশ্চর্য সংস্কার!        

গিরিশ: আমি তো কতবার বাবাকে বলেছিলাম দিদিকেও ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে। বাবাতো কিছুতেই রাজি হয়নি

 কারিয়াপ্পা: তুই থাম।

 গিরিশ: দিদিও রাজি হয়নি।  

গুন্ডাপ্পা: আশ্চর্য। তুমি কেন রাজি হওনি চেন্নী স্কুলে পড়তে?

চেন্নী: বাবা তো বলল বাবুজি। ইস্কুলে মেয়েরা পড়লে পরিবারের অকল্যাণ হয়। 

গুন্ডাপ্পা: ওটা তো তোমার বাবার শেখানো কথা। তোমার নিজের কি মনে হয়?

 চেন্নী: আমার কিছু মনে হয় না বাবুজি।

 গুন্ডাপ্পা: নিশ্চয় কিছু মনে হয়। তোমাকে ছোটবেলা থেকে যা বোঝানো হয়েছে তাই তুমি তোতা পাখির মতো বলছ।  সত্যি করে বলোতো তোমার কি ইচ্ছে হয় নি স্কুলে যেতে? ভায়ের মতো লেখাপড়া শিখতে? বই টই পড়তে? 

চেন্নী: না বাবুজি। 

গিরিশ: না না বাবুজি। দিদি মিছে কথা বলছে। আসলে ওর খুবই ইচ্ছে হয়।

 চেন্নী: না না বাবুজি। ভাই মিছে কথা বলছে। 

গিরিশ: না বাবুজি। দিদি মিছে কথা বলছে। 

 চেন্নী: তুই থামবি গিরিশ? 

গুন্ডাপ্পা: কী স্যাড ব্যাপার!

গিরিশ: কেন থামব?  তুই কি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখিস না? আমি নিজে একদিন দেখেছি। আমার একটা বই হাতে নিয়ে তুই ঝর ঝর করে কাঁদছিস। আর বিড়বিড় করে বলছিস  ‘’না না মেয়েদের এই বই টই পড়তে নেই। লেখাপড়া শিখতে নেই। লেখাপড়া শিখলে পরিবারের অকল্যাণ হবে। আমার ভাইয়ের অকল্যাণ হবে।’

 চেন্নী: (কেঁদে ফেলে) তুই কি থামবি গিরিশ?

 গিরিশ: না থামবো না। বাবুজি, দিদিকে বলো না আমার সঙ্গে স্কুলে পড়তে। বাবাকে রাজি করাও না গ্রামের স্কুলে যেন দিদিকে ভর্তি করে দেয়। 

 কারিয়াপ্পা: আহ্। গিরিশ। জ্বালাসনি বাবা। আমরা নীচু জাত। আমাদের ঘরের মেয়েদের লেখাপড়া করতে নেই। 

 গিরিশ: আমরা নীচু জাত কেন বাবা? আমরা সবাই তো এই স্বাধীন দেশের মানুষ। কেন কেউ উঁচু জাত? আবার কেউ নিচু জাত, দলিত জাত আমাদের মতো? এইতো সেদিন ইস্কুলে আমাদের একটা গান শেখানো হল।  আমার একজন মাস্টারমশাই গানটা গেয়ে গেয়ে আমাদের শেখালেন।  ওই গানটাতে তো  উঁচু জাত নিচু জাতের কথা নেই। ব্রাহ্মণ আর দলিতের কথা নেই।  বাবুজি শুনবে গানটা? 

 কারিয়াপ্পা: তুই যা। এখন বাবুজিকে গান শুনিয়ে বিরক্ত করবি না।বাবুজি এখন খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নেবেন।

 গুন্ডাপ্পা: না না। করুক না গানটা। আমি গান শুনতে ভালবাসি। গাও তুমি। আমি শুনি। 

(গিরিশ গান ধরে। মিলে সুর মেরা তুম হারা। গুন্ডাপ্পা গলা মেলায়। ওদের গান শেষ হয়ে গেলে চেন্নীকেও গুন্ডাপ্পা গান গাইতে বলে।)

 গুন্ডাপ্পা: তুমিও একটা গান করো চেন্নী। পারবে না গাইতে?

গিরিশ: হ্যাঁ। হ্যাঁ।  দিদিও গান গাইতে পারে।  গাও না দিদি। সেই ভজনটা। একদিন গুন গুন করে গাইছিলে পুকুর ঘাটে।

গুন্ডাপ্পা: হ্যাঁ। হ্যাঁ। গাও। গাও।  শুনব। 

কারিয়াপ্পা: মেয়েছেলে গান গাইলে অকল্যাণ হবে।  ওকে বলেছি অনেকবার। ও আমার কথা শুনতে চায় না। 

গুন্ডাপ্পা: তুমি থামো তো। সবকিছুতেই অকল্যাণ আর অকল্যাণ। horrible। মেয়েরা লেখাপড়া করলে অকল্যাণ - গান গাইলে অকল্যাণ।  কে বলেছে এসব কথা?

 কারিয়াপ্পা: তাই তো জানি বাবুজী। 

গুন্ডাপ্পা: ভুল জানো। ওসব ভুল কথা। সবসময় একটা ভয় তোমাদের তাড়া করে বেড়ায়। এইসব কথা বোলো না। গাও চেন্নী। তুমি গাও। 

চেন্নী: যদি পাপ হয় বাবুজি?

গুন্ডাপ্পা: হবে না। আমি বলছি। 

চেন্নী: ঠিক বাবুজি। আপনি বললে হবে না। আপনি তো দেবতা। 

গুন্ডাপ্পা: কী মুশকিল! তুমিও দেখছি তোমার বাবা মায়ের মত কথাবার্তা বলছো। ওসব বলো না। 

 চেন্নী: না না বাবুজি। আপনি দেবতা। 

 কারিয়াপ্পা: ঠিক ঠিক। বাবুজী ব্রাহ্মণ মানুষ।  বাবুজি তো দেবতাই। চেন্নী ঠিকই বলেছে। 

গুন্ডাপ্পা: তোমাদের বুঝিয়ে পারা যাবে না। 

গিরিশ: বাবুজি আমার কাছে দেবতা কিন্তু বিরাট কোহলি।  

গুন্ডাপ্পা: (হেসে ফেলে) এটা ভালো বলেছ।  ঠিক আছে চেন্নী। ভজনটা গাও শুনি।  

(চেন্নী ভজন গান করে। গান শেষ হলে গুন্ডাপ্পা  হাততালি দেয়। চেন্নাী লজ্জা পেয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।) 


(শবরী থালায় খাবার নিয়ে আসে। গুন্ডাপ্পার সামনে রাখে।) 

কারিয়াপ্পা: খেয়ে নিন, বাবুজী।

(গুন্ডাপ্পা খেতে শুরু করেন। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরে আলো নিভে যায়।)

(আলো জ্বলে। গুন্ডাপ্পার খাওয়া হয়ে গেছে)

 গুন্ডাপ্পা: প্রচুর খাওয়ালে কারিয়াপ্পা। এবার তো আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে। ঘুমোতে হবে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে।)

 কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ হ্যাঁ বাবুজি চলুন। আপনাকে পৌঁছে দিই যে ঘরে আপনার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। 

(ধীরে আলো নিভে যায়।)

(প্রথম ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)

(জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

গুন্ডাপ্পা: খাওয়া দাওয়া শেষ করে শোয়ার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে গেছি। গৃহস্বামী কারিয়াপ্পাই ওই ঘরে পৌঁছে দিল আমাকে। পশ্চিম দিকের একটা ছোট ঘর। একটা জানলা খোলা। ঝড়ের রাত। বৃষ্টি পড়ছে। তবে বৃষ্টির ছাট আসছে না। কিন্তু বাইরে হাওয়ার প্রবল মাতামাতি। গ্রামেতে ইলেকট্রিক কারেন্ট নেই। মনে হয় ঝড়ের জন্যেই কারেন্ট নেই। একটা কেরোসিনের কূপী মৃদু মৃদু জ্বলছে। আমি দরজা বন্ধ করে, পোশাক বদলে সবে শুয়েছি। আমার এক প্রস্থ রাতের পোশাক আমার ব্রীফকেসে সবসময় থাকে। একটু তন্দ্রা এসেছিল। এমন সময় দরজায় মৃদু করাঘাত। আমি একটু অবাক হয়ে দরজা খুলে দিই। দেখি কারিয়াপ্পার সেই মেয়ে চেন্নী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ঘরে ঢুকে আমি কোন প্রশ্ন করার আগেই নিঃসংকোচে দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল। আর আমাকে অত্যন্ত অবাক করে দিয়ে নির্দ্বিধায় যে প্রশ্ন আমাকে করল, তা উচ্চারণ করতে যে কোন ভদ্রজনই লজ্জিত হবেন। তবু তার কথা তো তার মতো করেই বলতে হবে আপনাকে। নাহলে আমার বিবরণ অসম্পূর্ণ হবে। মেয়েটি তার রিনরিনে কন্ঠে স্মিতমুখে বলল…


।। দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাক।। 


চেন্নী: বাবুজী, আমাকে চাই তো আপনার? 

গুন্ডাপ্পা: (অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে) মানে? তোমাকে চাই মানে? কী বলতে চাইছ তুমি? 

চেন্নী: (একটু অবাক হয়ে) আজ রাতে আপনার সেবার জন্যে? 

গুন্ডাপ্পা: (চমকে উঠে) কী? 

চেন্নী: (আরও অবাক হয়ে) বুঝলেন না বাবুজি? আমি মেয়েমানুষ। আরো খোলসা করে বলতে যে আমার লাজ লাগছে।

গুন্ডাপ্পা: (ক্রুদ্ধ হয়ে) তুমি কি বলতে চাইছ? এত রাতে তোমার মতো যুবতী মেয়ে পরপুরুষের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে… ছি ছি… তুমি চলে যাও। কীসের সেবা? আমার কোন সেবাটেবার দরকার নেই। 

চেন্নী: (ত্রস্ত হয়ে) না,না। রাগ করবেন না বাবুজী। আপনি অতিথি। কুলীন ব্রাহ্মণ। আপনি রাগ করলে দেবতার কোপ হবে আমাদের ওপর। আমাকে কি ভালো লাগছে না বাবুজী? আমি কি স্নান করে আসব? 

গুন্ডাপ্পা: কী সব বলছ? তোমাকে বলছি তুমি যাও। 

চেন্নী: (কাঁদো কাঁদো হয়ে) আপনি রাগ করছেন কেন বাবুজি? আমি তো আপনাকে সুখ দিতে এসেছি। আজ সারারাত আপনি আমাকে…..

গুন্ডাপ্পা: ছি ছি ছি। থামো। থামো। তোমার এসব কথা বলতে লজ্জা করছে না? 

চেন্নী: (অত্যন্ত অবাক হয়ে) কেন বাবুজী? 

গুন্ডাপ্পা: কেন? তুমি কী? ইস। তুমি একটা অত্যন্ত বাজে মেয়ে। এত খারাপ স্বভাব তোমার! 

চেন্নী: আপনি এসব কী কটু কথা বলছেন বাবুজি? 

গুন্ডাপ্পা: তুমি পাগল না শয়তান? 

চেন্নী: (ক্রুদ্ধ হয়ে) আপনি কেন আমাকে গালাগালি দিচ্ছেন? 

গুন্ডাপ্পা: গালাগালি দেব না তো কি ভাল বলব? তোমার এই স্বভাবের কথা বাড়ির লোক জানে? তোমার বাবাকে ডেকে বলব? নাকি এটা একটা ফাঁদ? তাই তো মনে হয়। এই শোনো - তোমার বাবা-মা কি তোমায় এখানে পাঠিয়েছে?

চেন্নী: হ্যাঁ। কেন? 

গুন্ডাপ্পা: (স্তম্ভিত হয়ে) ও। এই জন্যে এত খাতির করে আমাকে এখানে আনা? এটা প্রস্টিটিউটের বাড়ি! ইস।এই তুমি দরজা থেকে সরো। আমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাব। 

চেন্নী: (কেঁদে ফেলে) (অত্যন্ত ভীত হয়ে) না না বাবুজি। এই ঝড়ের রাতে আপনি যাবেন না। আপনার বিপদ হলে দেবতা আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমাদের অকল্যাণ হবে। আমরা শেষ হয়ে যাব। আমার বাবা মা ছোট ভাই - আমাদের সকলের সর্বনাশ হবে।

 গুন্ডাপ্পা: ন্যাকামি করবে না। কাঁদছ! আমার বিপদ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এরকম খারাপ প্রস্তাব করতে লজ্জা করে না? তুমি একটা অত্যন্ত খারাপ মেয়ে। তোমরা খুব খারাপ। 

চেন্নী: (কাঁদতে কাঁদতে) কীসব বলছেন? (উত্তেজিত হয়ে প্রবল চিৎকার করতে থাকে) আপনি কেন বারবার আমাকে খারাপ বলছেন - আমাদের খারাপ বলেছেন? 

গুন্ডাপ্পা: (শ্লেষের সাথে) এঃ বলবেনা! তুমি, তোমরা খারাপ নয়ত কি ভালো? 

চেন্নী: (কাঁদতে কাঁদতে) হ্যাঁ। ভালো। ভালো। গ্রামের সবাই জানে আমি ভালো - আমরা ভালো। সবাই জানে। সবাই। 

গুন্ডাপ্পা: বাইরে থেকে জানে। যদি জানতো ভেতরটা এতো সাংঘাতিক নোংরা - ছিঃ – 

চেন্নী: (কাঁদতে কাঁদতে) কেন খারাপ নোংরা এসব বলছেন আপনি? আমি কি দোষ করেছি?




গুন্ডাপ্পা: অদ্ভুত! দারুন শিক্ষা পেয়েছ তো বাবা-মার কাছ থেকে! কোনটা খারাপ তাও বোঝো না। শোনো। তোমার সদ্য যৌবন এসেছে। তাই তোমার বাড়ি তোমায় খুব খারাপ পথে নামিয়ে দিয়েছে। কেননা তোমার বাড়ি খুব খারাপ। তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা-মা ব্যবসা করছে। তুমি এসব বোঝোনা মনে হচ্ছে। তোমার বাড়ির কথায় এসব কোরো না। যাও। 

চেন্নী: (অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে) বাবুজি, আপনি এসব কি বলছেন? আপনি কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথি। অতিথি নারায়ন। আপনাকে সেবা করা, সুখ দেওয়াই তো আমার ধর্ম বাবুজি। আমি যে বাসবী।

গুন্ডাপ্পা: (বুঝতে না পেরে) বাসবী? তুমি বাসবী মানে? 

চেন্নী: বাসবী কী আপনি জানেন না বাবুজি? যে সব মেয়েদের দেবতার কাছে সঁপে দেওয়া হয়, তাদের বাসবী বলে বাবুজী।

গুন্ডাপ্পা: দেবতার কাছে সঁপে দেওয়া বলতে? 

চেন্নী: আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল আমার। তখন দেবতার পায়ে আমাকে সঁপে দেওয়া হয়েছিল। 

।। দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাক শেষ।। 


।। তৃতীয় ফ্ল্যাশব্যাক।। 

(মন্দির)

কারিয়াপ্পা: পুরুত মশাই, রক্ষা করুন আমার মেয়েকে.। রক্ষা করুন ওকে ঠাকুর মশাই।

শবরী: হ্যাঁ, ঠাকুর মশাই। আপনিই পারেন  আমাদের মেয়ে কে বাঁচাতে। ভীষণ কঠিন অসুখে  ভুগছে ও। আপনি না বাঁচালে ও কিছুতেই বাঁচবে না পুরুত মশাই। 

পুরোহিতঃ ওরে অবোধ, আমি কেউ নয় বাবা। সবকিছুই দেবতার হাত। ঠাকুরের হাত। 

কারিয়াপ্পা: আপনি ঠাকুরকে বলুন আমাদের মেয়েকে বাঁচাতে। ওকে সুস্থ করে তুলতে। আপনার কথা দেবতা নিশ্চয় শুনবেন। 

শবরী: অতটুকু ছোট্ট মেয়ে আমার। ওর কষ্ট দেখে আমাদের বুক ফেটে যায়। সারাদিন আমরা শুধু চোখের জল ফেলি। রক্ষা করুন পুরুত মশাই আমাদের মেয়েকে। রক্ষা করুন ওর জীবন। 

পুরোহিতঃ তাহলে শোন কারিয়াপ্পা। তোদের মেয়ের জীবন যদি রক্ষা করতে চাস তাহলে তোদের মেয়েকে দেবতার পায়ে সঁপে দে। তোদের মেয়েকে বাসবী করে দে। তাহলে আর কোন ভয় থাকবে না। দেবতা তাহলে তোদের মেয়ের জীবন রক্ষা করবে। 

কারিয়াপ্পা: বাসবী?

পুরোহিতঃ হ্যাঁ। বাসবী। তোরা কি রাজি আছিস?

 কারিয়াপ্পা: ঠিক আছে পুরুত মশাই। আমরা রাজি। আমাদের মেয়ে কে বাঁচাতেই হবে। 

পুরোহিতঃ বাসবী হলে কিন্তু ওর আর কোনদিন বিয়ে দেওয়া যাবে না কারিয়াপ্পা। ওর আর কোনদিন বিয়ে হবে না।

শবরী: সে কি? আর কোনদিন বিয়ে হবে না? 

পুরোহিতঃ না। বাসবী মানে তো ওর সঙ্গে দেবতার বিয়ে হয়ে গেল। ও হয়ে গেল দেবতার কাছে সঁপে দেওয়া নৈবেদ্য। দেবতার ভোগের সামগ্রী।

 কারিয়াপ্পা: ঠিক আছে। আমরা রাজি। বাসবী হলে যদি ওর জীবন রক্ষা হয় তাহলে ওকে বাসবী করে দিন।

 শবরী: কী বলছ তুমি?

 কারিয়াপ্পা: ঠিকই বলছি শবরী। এছাড়া আমাদের মেয়েকে বাঁচাবার আর কোন উপায় নেই।

পুরোহিতঃ কিন্তু আর একটা কথা। সেটাও মেনে নিতে হবে।

 কারিয়াপ্পা: কী?

পুরোহিতঃ কোনো ব্রাহ্মণ যদি তোদের বাড়িতে কখনো অতিথি হয় তার সেবার জন্য তোদের মেয়েকে তার কাছে রাতের বেলায় পাঠাতে হবে। তার ভোগের জন্যে। 

 শবরী: (আঁতকে ওঠে) সে কি! 

পুরোহিতঃ হ্যাঁ। কেননা ব্রাহ্মণ হল দেবতা। আর দেবতার পায়ে তোরা তোদের মেয়েকে সঁপে দিয়েছিস দেবতার ভোগের জন্যে। তাই সেই অতিথি ব্রাহ্মণের ভোগের জন্যে রাতের বেলায় তোদের মেয়েকে তার কাছে সঁপে দিতে হবে।  তা না দিলে দেবতার অপমান হবে। তখন তোদের ওপর দেবতার  ভয়ানক  অভিশাপ নেমে আসবে। আর তোদের পরিবারের চরম অকল্যাণ হবে। তাই  তোদের মেয়ে বড় হয়ে রজস্বলা হলে তাকে এটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। পারবি তো তোরা?

কারিয়াপ্পা ও শবরী: (কাঁদতে কাঁদতে) হ্যাঁ পারব। 

পুরোহিতঃ (ক্রমশ চোখ রক্তিম ও গলার স্বর হিংস্র আর তীব্র হয়ে যায়। ভয় দেখাতে থাকে।) একবার মেয়েকে বাসবী করে দিলে আর ফেরার উপায় থাকবে না। ভবিষ্যতে তোদের মেয়ে বড় হলে যদি এসব না মানে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে তোদের পরিবারের। ধ্বংস হয়ে যাবি তোরা। শেষ হয়ে যাবি তোরা। কথার খেলাপ হলে দেবতার চরম অপমান হবে। তখন দেবতার কোপে তোরা সবাই শেষ হয়ে যাবি। তোদের বংশ লোপাট হয়ে যাবে।  

কারিয়াপ্পা ও শবরী: (প্রচণ্ড ভীত হয়ে) না না। কথার খেলাপ হবে না।

পুরোহিতঃ তোদের মেয়ের পরে তোদের একটা  ছেলে আছে তো?

কারিয়াপ্পা ও শবরী:  হ্যাঁ পুরুত মশাই। 

পুরোহিতঃ দেবতাকে ঠকালে তাকেও বাঁচাতে পারবি না। 

কারিয়াপ্পা ও শবরী: (প্রচণ্ড ভীত হয়ে) না না। দেবতাকে ঠকাবো না আমরা।

পুরোহিতঃ হ্যাঁ। এটা সারাজীবন মনে রাখবি। আর মেয়ে বড় হলে তাকেও বলবি এটা সারা জীবন মনে রাখতে। তোদের মেয়ের বিয়ে না হলে কোন ক্ষতি নেই। ছেলে বড় হলে তার বিয়ে দিবি। তোদের বংশ রক্ষা হবে। 

কারিয়াপ্পা ও শবরী:  হ্যাঁ, পুরুত মশাই। 

পুরোহিতঃ তাহলে  কাল সকালে ঠাকুরের পুজোর সময়  তোদের মেয়েকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে নিয়ে আসবি। কাল সকালেই তোদের মেয়েকে বাসবী করে দেব।

।। তৃতীয় ফ্ল্যাশব্যাক শেষ।। 


চেন্নী: সেই থেকে আমি বাসবী বাবুজি। যারা বাসবী, তাদের তো কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথিকে দেহ দিয়ে সেবা করতেই হবে। অতিথি যে দেবতা। আমরা যে দেবতার দাসী। আপনি আমাকে নিন বাবুজি। নিয়ে সুখী হোন। নাহলে দেবতার কাছে কথার খেলাপ হয়ে যাবে আমাদের। আমাদের অকল্যাণ হবে। বাবা-মা ভাই সকলের অকল্যাণ হবে। আমাকে নিন বাবুজি।

গুন্ডাপ্পা: থামো। থামো। ছি ছি। মূর্খ মেয়ে। কল্পনা করতে পারি না এসব এই সভ্য যুগে। কী অদ্ভুত খারাপ নিয়ম তোমাদের। শোনো এ যুগে এসব চলে না। এভাবে যেসব মেয়েরা পরপুরুষের হাতে নিজেদের তুলে দেয়, তাদের গণিকা বলে, পতিতা বলে, বেশ্যা বলে। বেশ্যাদের কথা শোনো নি তুমি? জানো না তারা টাকা নিয়ে পরপুরুষের কাছে নিজেদের দেহ বিক্রি করে? জানো না সমাজ তাদের ঘৃণা করে? তুমিও তাহলে সেরকম পতিতা বেশ্যা? 

চেন্নী: (আর্তনাদ করে) না। না। ওরকম বলবেন না বাবুজি। হ্যাঁ। আমি ওরকম মেয়েদের কথা জানি। তারা শরীর বেচে পয়সা নেয়। টাকা নিয়ে নিজেদের শরীর বিক্রি করে। আমি তা নই বাবুজি। (হাউ করে হাউ করে কেঁদে ফেলে) আমি তো বাসবী। আমি তো কোন পয়সা পেতে আসিনি। আমি তো এসেছি আপনার সেবার জন্য। 

গুন্ডাপ্পা: থামো। ওই একই হল। পতিতা শরীর বেচে পয়সা নেয়। তুমি শরীর বেচে তোমার বাড়ির, তোমার নিজের নিরাপত্তা কিনছ। দেবতার আশীর্বাদ কিনছ। তুমি খারাপ হয়ে গেছ। পতিতার লাইনে নেমে গেছ। তুমি বুঝতে পারছ না।

চেন্নী: (প্রচন্ড অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে) কিন্তু বড় হওয়া থেকে যে আমি জেনে এসেছি আমাকে এসব করতে হবে। শুনে আসছি আমি বাসবী। তাই আমাকে কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথিকে দেহ দিয়ে সেবা করতে হবে। হ্যাঁ। আমাদের সমাজে এটাই নাকি নিয়ম বাবুজি। বাসবীকে শরীর দিতেই হবে তার কুলীন ব্রাহ্মণ অতিথিকে। আপনি শহরের কুলীন ব্রাহ্মণ। অথচ আপনিই আমাকে পতিতা বলছেন। বেশ্যা বলছেন। তাহলে তাহলে….(থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে অস্বাভাবিক আওয়াজ করতে থাকে মুখ দিয়ে)….

গুন্ডাপ্পা: তাহলে আর কি। তুমি একটা বোকা মেয়ে। অশিক্ষিত মেয়ে। লেখাপড়া শেখোনি। তাই ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যে বুঝিয়ে তোমাকে দিয়ে বেশ্যার কাজ করানো হচ্ছে। কিন্তু এভাবে বাড়ির কল্যাণ হয় না।তোমারও হয় না। এতে তোমার ক্ষতিই হচ্ছে। তোমার সর্বনাশ হচ্ছে। 

চেন্নী: (প্রবলভাবে বিশ্বাস টলে যায়) তাই বাবুজি? আমি কি সত্যিই তাহলে পতিতা হয়ে গেছি?

 গুন্ডাপ্পা: তাইতো। তুমি পতিতা ছাড়া আর কী? 

চেন্নী: তাহলে আমার বাবা-মা এতদিন আমাকে ভুল বুঝিয়েছে? আপনারা শহরের বাবুরা তাহলে বাসবীদের পতিতা বলে মনে করেন? (অন্তর্দ্বন্দ্বে চুরমার হয়ে যায়) তাহলে দেবতা- ঠাকুর- আমার অসুখ সেরে যাওয়া - মানত - দেবতারা আদেশ - এসব মিথ্যে? 

 গুন্ডাপ্পা: তোমার অসুখ সেরে ছিল ওষুধ খেয়ে। আর যদি দেবতার আশীর্বাদেই অসুখ সেরে যায়, তা হলেই বা কি? দেবতা কি তোমাদের এরকম মানত করতে বলেছিল? তুমি নিজে শুনেছ? তোমরা নিজেদের কানে শুনেছ? 

চেন্নী: মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুর বলেছিল। 

গুন্ডাপ্পা: (অত্যন্ত বিদ্রুপের সঙ্গে ) পুরোহিত ঠাকুর বলেছিল!!

চেন্নী: হ্যাঁ। পুরোহিত ঠাকুর বলেছিল আমার বাবা-মাকে। বলেছিল মেয়েকে বাসবী করবে বলে মানত করো। তাহলেই মেয়ে সেরে উঠবে। তাই তো আমাকে – 

 গুন্ডাপ্পা: শোনো ওসব পুরোহিতদের শয়তানি।‌ ধাপ্পাবাজি। তোমাদের সমাজের পুরুষদের শয়তানি। কুলীনদের শয়তানি। তোমাদের মতো অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের পরিবারের মেয়েদের ভোগ করার জন্য পুরোহিতদের তৈরি করা এসব শয়তানি নিয়ম, প্রথা। এসব নিয়ম ভগবানের তৈরি করা নয়। ভগবানের নিয়ম এরকম খারাপ হয় না। মেয়েদের সর্বনাশ কি ভগবান চাইতে পারেন? তার কাছে তো মেয়ে পুরুষ সবাই সমান। এসব নিয়মে কাদের লাভ হয় দ্যাখো। লাভ হয় লোভী শয়তান যত পুরোহিত কুলীন ব্রাহ্মণদের। তাই তারাই এইরকম নিয়ম তৈরি করেছে। আর যুগ যুগ ধরে দেবতার নামে এসব চালিয়ে আসছে। তুমি ঘরে যাও। নিজেকে এভাবে আর খারাপ পথে ঠেলে দিও না। নোংরা পথে ঠেলে দিও না। 

চেন্নী: (ভেঙে পড়ে) তা হলেএসব নোংরা খারাপ! আমাকে ভুল বুঝিয়ে এরকম নোংরা পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে? বাবুজি, আমি তাহলে সত্যি খারাপ মেয়ে? নোংরা? পতিতা? আ আ আ আ আ আ ( তীব্র বীভৎস আর্তনাদ করে দৌড়ে চলে যায়। দ্রুত পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়।)

 গুন্ডাপ্পা: চেন্নী চেন্নী চেন্নী……. দীর্ঘ নীরবতা। 

(জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

গুণ্ডাপ্পা: জাস্টিস কৃষ্ণান, একটা বীভৎস চাপা অথচ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে চেন্নী দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেহেতু ওর আর্তনাদ খুব উচ্চগ্রামের ছিল না, তাই বাড়ির আর কারোর ঘুম ভাঙলো না। কেউ সাক্ষী থাকেনি তার এই মানসিক বিপ্লবের। শুধু আমি ছাড়া। ও ঘর ছেড়ে যাবার সময় আমি দেখলাম ওর চোখেমুখে এক অস্বাভাবিক ঘৃণা মিশ্রিত উপলব্ধি। ঘৃণা, হতাশা, জিঘাংসা, অথচ একটা আলো। একটা চেতনার দ্যুতিও যেন ফুটে উঠেছিল ওর চোখে।‌ ওর মাথা নাড়ায়, ওর অভিব্যক্তিতে। যেন চাবুকের একটা আঘাত কিংবা বিদ্যুতের একটা প্রবাহে একটা মাটির পুতুল থেকে একটা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে গেল মেয়েটা। সরল অবোধ মূর্খ গ্রাম্যবালিকা থেকে হয়ে গেল একটা পোড় খাওয়া নারী। একটা ম্যাচিউরড উওম্যান। এক লহমায় ওর চোখ থেকে যেন যাবতীয় সংস্কারের মিথ্যে আবরণ ছিন্ন হয়ে সরে গেল।

কৃষ্ণান: এ তো ভালোই হলো। ও নিজেকে চিনতে পারল।‌

 গুণ্ডাপ্পা: না জাস্টিস কৃষ্ণান। কদর্য বাস্তবের নির্মম সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে সে একেবারে তলিয়েই গেল। সাঁতরে উঠতে পারল না। মেয়েটা সেই রাতেই আত্মহত্যা করল। 

কৃষ্ণান: সেকি! 

গুণ্ডাপ্পা: হ্যাঁ। জাস্টিস কৃষ্ণান।‌ সেই রাতই ছিল তার শেষ রাত। মেয়েটা চিলেকোঠার ঘরে গলায় দড়ি দিল। 


।। চতুর্থ ফ্ল্যাশব্যাক।।

(সকাল হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। গুণ্ডাপ্পা ব্রিফকেস নিয়ে ভেতর থেকে মঞ্চে আসেন। নেপথ্যে কান্নার আওয়াজ।) 

 গুণ্ডাপ্পা:…….(আপন মনে) কে কাঁদছে? কারিয়াপ্পা! কারিয়াপ্পা!

(শোকার্ত ও বিধ্বস্ত কারিয়াপ্পা টলতে টলতে ভেতর থেকে আসে)

 গুণ্ডাপ্পা: কারিয়াপ্পা, সকাল হয়ে গেছে। ঝড়বৃষ্টিও থেমে গেছে। এবার আমি যাবো। 

কারিয়াপ্পা: হ্যাঁ। বাবুজী। 

 গুণ্ডাপ্পা: কী হয়েছে তোমাদের? তোমরা সবাই কাঁদছ কেন?

 কারিয়াপ্পা: (প্রবল ভাবে কেঁদে ফেলে) আমার মেয়ে চেন্নী রাতের বেলায় চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। 

 গুণ্ডাপ্পা: সেকি! 

(শবরী আর্তনাদ করতে করতে ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে ভেতর থেকে আসে। পেছন পেছন গিরিশও ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে আসে।)

শবরী: আ আ আ আ আ আ। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল বাবুজী। চেন্নী আর নেই। আমার মেয়েটা আর নেই।

গিরিশ: (প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে) দিদি রে। দিদি গো। আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলি!

 কারিয়াপ্পা: (কাঁদতে কাঁদতে) বাবুজী। চলুন আপনাকে গাড়িতে তুলে দিই।  

(গুণ্ডাপ্পার চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে)

গুণ্ডাপ্পা: না না। এ সময় তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি। 

শবরী: না বাবুজী। আপনি যাবেন না। (পাগলের মত হয়ে যায়। ওর দৃষ্টি অস্বাভাবিক হয়ে যায়) আপনাকে বলতে হবে কেন  মরল আমার মেয়েটা।  কেন ও হঠাৎ গলায় দড়ি দিল? কী হয়েছিল রাতের বেলায় বাবুজী? আপনার ঘর থেকে কেন ওর চেঁচামেচি কান্নাকাটি ভেসে আসছিল মাঝরাতে? কেন? কেন? কেন ও ভীষণ চেঁচিয়ে উঠেছিল? কীসের তর্ক বিতর্ক ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছিল ওর সঙ্গে আপনার বাবুজী? আপনি ওকে কি বলেছিলেন? বলুন। বলুন। বলতে হবে আপনাকে।  

গুণ্ডাপ্পা: তার আগে বলো গভীর রাতে ও কেন আমার ঘরে গেছিল। একজন যুবতী মেয়ে হয়ে পরপুরুষের ঘরে কেন ও রাতের বেলায় গেছিল? কারা পাঠিয়েছিল ওকে আমার ঘরে?  কেন ও গেছিল আমার ঘরে মাঝরাতে?

 শবরী: ওতো বাসবী। ওকে তো আপনার ঘরে যেতে হবেই রাতের বেলায়। কেননা  আপনি ব্রাহ্মণ অতিথি। দেবতা। ও বাসবী। ও যদি না যেত তাহলে আমাদের পরিবারের  চরম অকল্যাণ হোত। 

গুণ্ডাপ্পা: থামো মূর্খের দল।  এখন কি তোমাদের পরিবারের কল্যান হল? লজ্জা করে না তোমাদের নিজেদের মেয়েকে পরপুরুষের  কাছে রাতের বেলায় পাঠাতে তার ভোগের জন্যে? আমি সব শুনেছি চেন্নীর কাছে। তাকে বলেছি এভাবে নিজেকে নষ্ট করা উচিত নয়।  বলেছি তাকে এই পথ থেকে সরে যেতে। বলেছি তাকে এটা পতিতার পথ। এটা পতিতাগিরি। 

 শবরী: (গুন্ডাপ্পার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর জামাটা খামচে ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকাতে থাকে)  পতিতা? পতিতা? পতিতা? আমাদের মেয়ে পতিতা?  আমাদের মেয়ে পতিতা? আমাদের মেয়ে পতিতা? পরিবারের কল্যাণের জন্য নিজেকে ব্রাহ্মণ দেবতার কাছে সঁপে দেওয়াকে পতিতাগিরি বলে? 

গুণ্ডাপ্পা: হ্যাঁ। হ্যাঁ। একে  পতিতাগিরিই বলে।  নিজের দেহকে পরের কাছে এভাবে তুলে দেওয়াকে পতিতাগিরিই বলে। পরিবারের কল্যাণের নাম করে হলেও একে পতিতাগিরিই বলে। 

 শবরী: আপনি ব্রাহ্মণ। দেবতা।চেন্নী বাসবী হয়ে আপনার কাছে গেছিল বলে তাকে পতিতা বলছেন?

 গুণ্ডাপ্পা: হ্যাঁ বলছি। বলছি। আমি দেবতা নই। আমি একজন সাধারণ মানুষ তোমাদের মতো। তোমরা মূর্খ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ব্রাহ্মণ পুরুতের মিথ্যে কথায় নিজেদের মেয়েকে সারাজীবনের জন্যে পতিতা বানিয়ে দিয়েছ। তাকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দাওনি। তাকে লেখাপড়া শেখাওনি। তাকে বিয়ে করে সুখী হতে দাওনি। তাকে শিখিয়েছ সারা জীবন ধরে বেশ্যবৃত্তি করতে। তাকে শিখিয়েছ ব্রাহ্মণদের কাছে নিজের শরীর বেচে দিতে। পরিবারের অকল্যাণের ভয় দেখিয়ে। তোমরা অমানুষ। তোমরা নিজেদের মেয়েকে বেশ্যা বানিয়েছ। আর সেটা সে বুঝতে পেরেই ঘেন্নায় গলায় দড়ি দিয়েছে। তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী তোমরা তোমরা তোমরা। 

শবরী: (কারিয়াপ্পাকে) শুনছ? সব শুনছ? তুমি কিছু বলো। বলো। বলো। (শবরী কান্নায় ভেঙে পড়ে কারিয়াপ্পার জামাটা খামচে ধরে)। আমাদের মেয়ে কি সত্যিই পতিতা ছিল? ও কি পতিতাগিরি করত? বলো। বলো।

 কারিয়াপ্পা: (কান্নায় ফেটে পড়ে) জানি না। জানি না। বুঝতে পারছি না। আমাদের তো বলা হয়েছিল বাসবী বলে ওকে নিজেকে সঁপে দিতে হবে ব্রাহ্মণ অতিথির কাছে। কিন্তু বাবুজী তো বলছে ও পতিতা। ও সারা জীবন পতিতাগিরি করেছে।  

শবরী: (কান্নায় ফেটে পড়ে) এটা সত্যি না মিথ্যে? বলো। বলো।বলো। 

কারিয়াপ্পা: (কান্নায় ফেটে পড়ে) জানি না। জানি না। জানি না।  

শবরী: (কান্নায় ফেটে পড়ে) হায় ভগবান। জীবন চলে গেল আমার মেয়ের। কিন্তু মরার আগে ও জেনে গেল ও পতিতা। হায় ভগবান।  

গিরিশ: হায় ভগবান। আমার দিদি পতিতা। আমার দিদি পতিতা। হায় ভগবান। হায় ভগবান। 

(ওরা তিনজন প্রবল কাঁদতে থাকে। গুণ্ডাপ্পা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।) 

(চতুর্থ ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)

(জাস্টিস কৃষ্ণানের ড্রইংরুম)

গুণ্ডাপ্পা: মিস্টার কৃষ্ণান, আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা আমি কি আইনের চোখে চেন্নীর মৃত্যুর জন্যে দায়ী?

কৃষ্ণান: ওর বাড়ির কেউ কি  আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেছে পুলিশের কাছে?

 গুণ্ডাপ্পা: ওই ঘটনার পর একটি সপ্তাহ চলে গেছে। কই পুলিশ তো আমায় খোঁজেনি।     

 কৃষ্ণান: তাহলে সমস্যা কিসের? 

 গুণ্ডাপ্পা: পুলিশ আমাকে না খুঁজলেও কিংবা আইনের চোখে আমি অপরাধী না হলেও আমি কি সত্যিই নির্দোষ জাস্টিস কৃষ্ণান?

কৃষ্ণান: আপনি নিজেকে দোষীই বা ভাবছেন কেন প্রফেসর গুণ্ডাপ্পা?

 গুণ্ডাপ্পা: আমি দোষী নয় বলছেন?

কৃষ্ণান: না। কেন আপনার এত  অপরাধবোধ প্রফেসর? আপনি কোন অপরাধ করেননি। আইনের চোখে তো নয়ই। 

 গুণ্ডাপ্পা: আমি কি তাকে আত্মহননে প্ররোচিত করিনি?

কৃষ্ণান: না। কী করে তা হয়? আপনি তাকে সুস্থ জীবনের কথা বলেছেন। তার অসুস্থ জীবন সম্পর্কে তাকে সচেতন করে দিয়েছেন। এটাতো আত্মহত্যায় প্ররোচনাদান নয়। 

 গুণ্ডাপ্পা: তাহলে সে আত্মঘাতী হল কেন? 

 কৃষ্ণান: তার অপরাধবোধ থেকে সে আত্মহত্যা করেছে। তবে এইজন্যে তাকেও দায়ী করা যায় না। সে একটা সিস্টেমের শিকার। তাই এই আত্মহত্যাকে দুর্ঘটনা বলাই যুক্তিসম্মত। অন্তত আমার বিচারে। দেখুন প্রফেসর। ল ইজ নাথিং বাট স্ট্রং কমন সেন্স। আমরা যেসব আইনের ভিত্তিতে বিচার করি সেসবের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। ভবিষ্যতের মানুষ হয়তো সেইসব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করবে। আপনি ওই মেয়েটির মৃত্যুর জন্যে দায়ী নন। 

 গুণ্ডাপ্পা: কিন্তু জাস্টিস কৃষ্ণান আমি তো পরোক্ষে তার মৃত্যুর কারণ হলাম। মেয়েটা তো তার অজ্ঞানতা নিয়ে ওই পথেই তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারত। সেই পথ ভ্রান্ত  আর পঙ্কিল হলেও। আমি তো তার  জীবনটা কেড়ে নিলাম চেতনার বিষ পান করিয়ে।  একটা সরল সুন্দর মেয়ে। কি অপরূপ তার স্নিগ্ধ অনাবিল দৃষ্টি।  সারল্যে ভরপুর। মমতায় পূর্ণ। সভ্যতার মাপকাঠি যে জানত না। ভয়ানক সরল চিত্তে যে  প্রথাকে অনুসরণ করত। যার মধ্যে কোন অপরাধবোধ  ছিল না। পাপবোধ ছিল না।  আমি তো তার জীবনটাকে কে়ড়ে নিলাম  জাস্টিস কৃষ্ণান। কি অপূর্ব সুধায় ভরা তার কন্ঠ। তার গানেতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। শিক্ষায় বঞ্চিত এক নিপীড়িত মেয়ে। প্রথার শিকার হয়ে সভ্যতার বিচারে কদর্য ঐ জীবন সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কিছু না বুঝেই। তবুও তো তার বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। আমি তো তার সেই অধিকার হরণ করলাম। হারিয়ে গেল একটা সরল  সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবী থেকে। ঝরে গেল একটা কুড়ি। আমারই অপরাধে। হ্যাঁ জাস্টিস কৃষ্ণান। আইন আমাকে  অভিযুক্ত না করলেও আমিই হত্যা করেছি ঐ ফুলের মতো মেয়েটাকে।  (আর্তনাদ করে)

কৃষ্ণান: প্রফেসর আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি  আপনি  ওভার রিয়্যাক্ট করছেন। আপনি চিৎকার করে কাঁদছেন। ইউ আর গেটিং সিলি।  গেট কুল প্লিজ।

গুণ্ডাপ্পা: ও  জাস্টিস কৃষ্ণান। আই এম সরি টু ডিস্টার্ব ইউ।  কিন্তু আমি যে এক গভীর অপরাধবোধে ভেতরে ভেতরে  চুরমার হয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমি ভুলতে পারছিনা  মেয়েটার অসহায় বাবা মা আর ভাইয়ের বুকফাটা কান্না। যত ভুলই  তারা করে থাকুক। আমি তো মেনে নিতে পারছি না তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমারই ভুলে। (কান্নায় ভেঙে পড়ে) আই এম সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। কিন্তু আমি তো  নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা জাস্টিস কৃষ্ণান। কেন চেতনার  বিষপান করালাম ওই অবোধ  সরল গ্রাম্য মেয়েটিকে। 

কৃষ্ণান: না প্রফেসর। চেতনা কখনো বিষ হতে পারে না। তার মৃত্যুর জন্যে সত্যিই আপনি দায়ী নন। তার মৃত্যু একটা প্রতিবাদ। যুগ-যুগান্তরের কদর্য সামন্ততান্ত্রিক প্রথার আর সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। যে  প্রথার, যে সমাজব্যবস্থার শিকার ওই মেয়েটি। তার মৃত্যু ঐ ব্যবস্থার মৃত্যুর  পূর্বাভাস। ওই ব্যবস্থার কফিনে একটা পেরেক। আপনি আপসেট। আপনি  বাড়ী যান প্রফেসর। 

                   ।।যবনিকা।।

(কন্নড় কাহিনী অনুপ্রাণিত)

(অভিনয়ের অনুমতির জন্য যোগাযোগঃ 8910019589)

নাটক: আপনি ভুল দেখেছেন -
অনুপ চক্রবর্তী
Dec. 3, 2024 | নাটক | views:1011 | likes:0 | share: 0 | comments:0

চরিত্র: অর্ণব। সুনীল (অর্ণবের বাবা)। অনিল (অর্ণবের কাকা)। তপতী (অর্ণবের মা)। সোমা। রথীন দত্ত। মৌসুমী, তাপস ও প্রশান্ত ওসি। সাবইন্সপেক্টর। প্রথম পুলিশ। দ্বিতীয় পুলিশ।

।। প্রথম দৃশ্য।।

(অর্ণবদের বাইরের বসার ঘর। অর্ণব, অর্ণবের বাবা আর কাকা গুম হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে  বসে আছে। অর্ণবের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। রাত ন’টা হবে। সোমা বাইরে থেকে দ্রুত আসে।)

সোমা: কী হয়েছে অর্ণব? কী সমস্যা হয়েছে যে  ওভাবে মেসেজ করে এখনি আসতে বললে? একি? তোমরা সবাই এরকম গুম মেরে আছো কেন? তুমি কাকু কাকিমা ছোটকাকু? কি হয়েছে তোমাদের? এ’কি কাকিমা? আপনি কাঁদছেন কেন?

অনিল:  আমি বলছি সোমা।

সোমা:  হ্যাঁ। বলুন ছোটকাকু। কী হয়েছে?

অনিল:  কিছুক্ষণ আগে আমার এই দাদাটি চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিতে গেছিলো।

সোমা: সেকি!

অনিল: আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় ও সেটা করতে পারেনি। 

সোমা: সেকি! কেন? (সুনীল বাবু হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন। অর্ণবের মাও। এমনকি অর্ণবও।) একি!  কী ব্যাপার? সবাই মিলে এভাবে ভেঙে পড়ছেন কেন?  অর্ণব, তুমিও এইভাবে ভেঙে পড়ছ কেন? কী হয়েছে? কেন কাকু এরকম করতে গেলেন?

অনিল: আমি বলছি তোমাকে সোমা। অর্ণবের চাকরি চলে গেছে। 

সোমা: সেকি! কেন? 

অনিল: হাইকোর্টের অর্ডারে। 

সোমা: কেন? 

 অনিল: তুমি জানো না কয়েকটিদিন ধরে হাইকোর্ট কি অর্ডার করে চলেছে। কয়েকদিন ধরে কয়েকশো জন প্রাইমারি টিচারের চাকরি চলে গেছে। আজকেও অনেকের চাকরি চলে গেছে। তার মধ্যে অর্ণবও একজন। 

সোমা: কেন অর্ণব? তুমি তো চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেয়েছিলে। (ডুকরে কেঁদে ওঠে অর্নব)

অনিল: না সোমা। 

সোমা: তার মানে?

অনিল: সে বড় লজ্জার কথা সোমা। যারা চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে দালালদের ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল, হাইকোর্ট তাদের ধরে ফেলে একে একে বরখাস্ত করেছে। আজ জানা গেছে অর্নবও তাদের মধ্যে একজন। আমি অর্ণবেরও এরকম ব্যাপার জানতাম  না। একটু আগে সব শুনলাম। 

সুনীল: সোমা, জমানো শেষ সঞ্চয় দশ লাখ টাকা দালালকে দিয়েছিলাম ওর চাকরির জন্য। ওর বোনের বিয়েতে আগেই পনেরো লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। শেষ সঞ্চয়টা দিয়ে দিয়েছিলাম দালালকে। কেননা তুমি জানো না আমি বিএসএনএলের স্টাফ হলেও গত দু বছর কোন মাইনে পাইনি। কোনোদিন পাবো বলে মনে হয় না। বরং একেবারে তাডিয়ে দেবে হয়তো কিছুদিন পরে। সংসারের খরচ চলত অনেক কষ্ট করে অর্ণবেরই  টিউশনির টাকায়। তাই বাঁচার জন্য অর্ণবের চাকরির জন্য দালালকে দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলাম।

অনিল: অন্যায় করেছিলে।

সুনীল: তুই আমাকে এরকম বলছিস! এইসময়ে! একটু আগে মরতে যাচ্ছিলাম। তুই নিজেই বাঁচালি।

 অনিল: তবুও বলছি দাদা খুব অন্যায় করেছিলে। চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছিল তারা তো ঐ পরীক্ষায় পাশ করা ক্যান্ডিডেটদের চাকরিটা দখল করেছিল। এটা অন্যায় নয়?

 সুনীল: আর আমার যে বছরের পর বছর মাইনে বন্ধ করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার সেটা অন্যায় নয়? 

অনিল: সেটাও ঘোরতর অন্যায়। সেটাও ক্রাইম। এটাও ক্রাইম।

অর্ণব:  আমার এছাড়া কী করার ছিল? আমি তো অনেক রকম চাকরির পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম বছরের পর বছর। চাকরি না পেলে কী করব? 

অনিল: হকারি করবি আমার মতো। আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম না। চাকরি পাইনি। তাই হকারি করে পেট চালাই। তাই করতিস। তাই করবি। দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কেন চাকরি করবি? এটা তো চরম দুর্নীতি। যোগ্য ক্যান্ডিডেটের চাকরি চুরি করে পাওয়া। শর্টকাট  রাস্তায় গেছিলিস। এখন কি হলো। টাকাটাও গেল। চাকরিটাও গেলো। সম্মানটাও গেল।

 অর্ণব: ঠিক বলেছ। আমারই দোষ। বাবা নয়, সুইসাইড আমারই করা উচিত। 

সোমা: অর্ণব তুমি থামো। একটু শান্ত হও। আমাকে হালটা ধরতে দাও। যদিও আমি তোমাদের পরিবারের কেউ নয়।

অনিল: কে বলেছে তুমি আমাদের পরিবারের কেউ নয়? আমরা তো সবাই জানি তুমি অর্ণবকে ভালোবাসো। আমাদের সকলকে ভালোবাসো। আমরাও সকলে তোমাকে ভালোবাসি। আমরাও সবাই চেয়েছিলাম তুমি আমাদের পরিবারের একজন হও। আমাদের বাড়ির বউ হও। অর্ণবের বউ হও। 

সোমা: চেয়েছিলেন ছোটকাকু? মানে এখন কি আর চান না?

অনিল: কি করে চাইবো। সবতো সর্বনাশ হয়ে গেল। 

সোমা: কিচ্ছু সর্বনাশ হয়নি। 

অনিল: কী বলছ তুমি?

সোমা: অর্ণবের চাকরি চলে গেল। আমার চাকরিটাতো আছে? পাকা চাকরি ব্যাংকের। আমার চাকরি যাবে না। 

অর্ণব: এরপরও তুমি আমাকে বিয়ে করবে সোমা? 

সোমা: হ্যাঁ। কেন করব না? কেন তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না?

অর্ণব: তোমাকে বিয়ে করার মুখটা আমার আছে? আমারতো সম্মানটাই চলে গেল। 

সোমা: ও সব ঠিক হয়ে যাবে।

অর্ণব: আমি তো চোর সমাজের চোখে। 

সোমা: না। তুমি চোর নয়। তুমি ভিকটিম। এই পোড়া দেশে এই পোড়া সমাজে অন্যায়  সমাজব্যবস্থার একটা শিকার তুমি। আমি চাকরিটা পেয়ে গেছি। তুমি চেষ্টা করেও পাওনি। আমার অবস্থা তোমার মতো হতে পারত। চাকরি না পেয়ে সংসার কে বাঁচাতে তুমি ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলে। অপরাধী তারা যারা তোমাদের ঘুষ দিতে বাধ্য করে। মানে যারা দেশটা চালায়। কাকে টাকা দিয়েছিলে তোমরা?

 অর্ণব: এই পাড়ারই এক দালালকে। একটা নেতা।

অনিল: কে দাদা?

সুনীল:  রথীন দত্ত। 

অনিল: ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা? ওর নাম্বারটা আমাকে দাও তো। 

সুনীল: কেন? কি লাভ? ও কি টাকা ফেরত দেবে? হয়তো স্বীকারই করবে না। 

অনিল: তুমি ওকে কল করে ফোনটা আমাকে দাও।  আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। যা বলছি করো। দ্যাখো আমি কী করি। হয়ত কাজ হবে।

(সুনীল রথীনকে কল করে ফোনটা অনিলকে দেয়)

অনিল: হ্যালো রথীন বাবু। আমি সুনীল বোসের ভাই অনিল বলছি। আপনি এখনই আমাদের বাড়িতে একবার চলে আসুন। হ্যাঁ। এখনই। ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার।  না না। আপনি কেন আমাদের চাকর হবেন? বরং উল্টোটা। না আমরা কোথাও যাবো না। দাদাও কোথাও যাবে না। আপনি না আসলে কিন্তু আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। কী হয়েছে? কিছুক্ষণ আগে আমার দাদা চিলেকোঠায় গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিল। আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় দিতে পারেনি। ওর লেখা একটা সুইসাইড-নোট আমার পকেটে আছে। সেখানে আপনার বিরুদ্ধে ওর নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ওর মানসিক অবস্থা ভালো নয়। ও আবার কিন্তু সুইসাইড করার চেষ্টা করতে  পারে। সেটা যদি করে ফেলে তখন আমি ওর ঐ সুইসাইড নোটটা পুলিশকে দেব। তখন আপনার কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? ব্ল্যাকমেল বলুন আর যাই বলুন সেটাই হতে পারে। ঠিক আছে তাহলে আসছেন তো? না। তেমন রাত হয় নি।  হ্যাঁ ঠিক এখনই আসুন। রিস্ক নেবেন না। বাইকে আসতে তো আপনার দুমিনিট লাগবে। আসুন। (ফোন বন্ধ করে)

সোমা: কাজ হবে ছোটকাকু?

অনিল: দেখা যাক। ওরা তো ভীষণই পাজি। পাক্কা ক্রিমিনাল। তবে দ্যাখো সোমা আমিও দুঁদে হকার।  ওই রথীন দত্ত ওদের দলের একটা পান্ডা বটে। আমিও হকার ইউনিয়নের একটা পান্ডা। আমার গরমটা একটু দেখো।

সুনীল: অনিল, তুই কেন ওদের সঙ্গে লাগছিস? ওরা খুব খারাপ। যা গেছে গেছে। টাকার জন্যে ভাইকে হারাতে চাই না। (ফুঁপিয়ে কাঁদে) 

অনিল:  তুমি থামো। তাহলে টাকার জন্যে নিজেকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলে কেন? আমার কিছু হবে না।

(সুনীল ফুঁপিয়ে কাঁদে)  

সোমা: কাকু শান্ত হোন। কাঁদবেন না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন। একটু জল খাবেন?

সুনীল: না। থাক। ঠিক আছে। 

(রথীন দত্ত বাইরে থেকে আসে। খুব বিরক্ত।)

রথীন:  কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

অনিল:  আপনাকে তো ফোনে বললাম রথীনবাবু। 

রথীন: সেতো জানলাম। কিন্তু  ব্যাপারটা কী? দেখি সুনীলদার সুইসাইড নোটটা।

 অনিল: না। সেটা এখন আপনাকে দেব না। আমাদের মুখের কথাটাই এখন আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। 

রথীন: আমি কী করেছি সুনীলদা যে আমাকে অভিযুক্ত করে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে? 

সুনীল: (চেঁচিয়ে ওঠে) তুমি কি জানো আজ হাইকোর্টের অর্ডারে অর্ণবের চাকরি চলে গেছে?

রথীন:  সেকি! আমি তো জানতাম না। 

সুনীল: আমাকে দশ লাখ টাকা ফেরত দাও।

রথীন:  কী আজেবাজে বকছো? আমি তোমাকে টাকা দেব কেন? 

সুনীল: কারণ তুমি অর্ণবের চাকরির জন্যে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছ। আমি নিজের হাতে তোমাকে সেই টাকা ক্যাশ দিয়েছি। 

রথীন: কোন প্রমাণ আছে?

সুনীল: মানে!!! তুমি অস্বীকার করছ?

রথীন: হ্যাঁ করছি।

সোমা:  আপনাদের মতো চোরেরাই এভাবে অস্বীকার করতে পারে। 

রথীন: এই সোমা। মুখ সামলে। খুব সাবধান। তোমার পলিটিক্স করা ঘুচিয়ে দেব। আমি তোমাকে চিনি। কিন্তু তুমি আমাকে ঠিক চেনো না।

সোমা: ভীষণ চিনি। আমি ভয় পাচ্ছি না। যা ইচ্ছে করবেন।

অনিল:  রথীনবাবু, আপনি অস্বীকার করছেন তো? দাদার মানসিক অবস্থাটা দেখছেন? ও যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে, তাহলে কিন্তু সুইসাইডাল নোটটা আমরা পুলিশের কাছে জমা দেব।  নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো তখন? 

রথীন: (একটু থেমে) দেখো সুনীলদা। তুমি ওসব করতে যেও না। হ্যাঁ। স্বীকার করছি তুমি টাকা দিয়েছ।

অনিল: এইবার পথে এসেছে।

রথীন: কিন্তু বিশ্বাস করো। আমি তার থেকে এক লাখ টাকা মাত্র নিয়েছি। কাল সকালে ব্যাংক থেকে তুলে সেটা তোমাকে ফেরত দেব।

সুনীল:  আর বাকি ন লাখ টাকা?

রথীন: ওটা আমার কাছে নেই।

সুনীল:  নেই মানে? কার কাছে আছে?

অনিল: ওটা ওপরতলায় চ্যানেলে পাঠানো হয়ে গেছে।

অনিল: বুঝতে পারছ সোমা চুরির জালটা কতদূর ছড়িয়ে আছে?

সোমা:  আমরা সেসব শুনতে চাই না। আপনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন। আপনি ঠিক দশ লাখ টাকাই ফেরত দেবেন। 

রথীন: মাস্তানি করছ? তুমি এসব বলার কে?

সোমা: আমি অর্ণবের ভাবী স্ত্রী। 

রথীন: পুরো স্ত্রী হলে তখন গলাবাজি করবে। 

সোমা: তার মানে  আপনি পুরো দশ লাখ টাকা দেবেন না?

 রথীন: না। কোত্থেকে দেব? ওটা আমার কাছে নেই। বললাম তো চ্যানেলে পাঠানো হয়ে গেছে।

 সোমা: ফেরত আনুন। 

রথীন: সম্ভব নয়। চাইলেও ফেরত পাব না। 

সোমা: কাদের পাঠিয়েছেন? তাদের নাম বলুন।

রথীন: বলব না। 

সোমা: কেন?

রথীন: বলা সম্ভব নয়।

সোমা: কেন?

রথীন: আমি মার্ডার হয়ে যেতে চাই না।

সোমা:  আমরা কিন্তু পুলিশে যাব। বলবো আপনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন।

রথীন:  যাও। আমি অস্বীকার করব। বলব তোমরা মিথ্যে কথা বলছো। কী করবে তখন? প্রমাণ করতে পারবে? 

অর্ণব: (লাফিয়ে উঠে রথীনের গলা টিপে ধরে) স্কাউন্ড্রেল!

রথীন: এই কি করছ! ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে।

(ধ্স্তাধস্তি হয়। অনিল ছাড়িয়ে দেয়।)

রথীন: (রাগে কাঁপছে)খুব খারাপ করলে অর্ণব। তুমি আমাকে জানো না। 

অর্ণব: খুব জানি। আপনি এলাকার মার্কামারা খতরনাক দুনম্বরী নেতা। আপনার হাতে অনেক গুন্ডা। অনেক মার্ডার করিয়েছেন। আমাকে মার্ডার কোরবেন তো? যান। আমাকে মার্ডার করান। 

অনিল: রথীন বাবু আমার ভাইপোর আর কোন ক্ষতি করবেন না। এই পর্যন্ত যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। বাড়ির দশ লাখ  টাকা চলে গেছে।ওর চাকরিটাও চলে গেছে। সম্মানটাও চলে গেছে। এবার রেহাই দিন। এরপরেও যদি কিছু করেন। তাহলে এই সুইসাইডাল নোটটা কিন্তু আমরা থানায় জমা দেব। আপনিও দেখবেন আমরা কতদূর যেতে পারি।  (আগুনের মত তাকিয়ে রথীন চলে যায়।)

অনিল: ব্যাপারটা খুব খারাপ হল। তুই মাথা গরম করে ওর গায়ে হাত না দিলেই পারতিস অনু। খুব ডেঞ্জারাস ওরা।

অর্ণব: কী করবে? আমাক মেরে ফেলবে তো? ওকে তো বললাম  আমি সেটার পরোয়া করি না। বাবার শেষ সঞ্চয়টা তো নষ্ট করে দিলাম। চাকরিটা চলে গেল। সবাই জেনে গেল।‌ সম্মানটাও  চলে গেল। আর বেঁচে কি হবে? আমাকে আটকালে কেন? ওকে আজই গলা টিপে মেরে ফেলে না হয় ফাঁসি যেতাম।

সোমা:  কেন অর্ণব? একটা আরশোলাকে মেরে ফেলে নিজের জীবন নষ্ট করবে কেন? ঐ নরকের কীটের চেয়ে তোমার জীবনের দাম লক্ষ গুণ বেশি। যা গেছে যাক। টাকা, চাকরি, সো কলড পাবলিক প্রেস্টিজ -  সব কিছুর চেয়ে তোমার জীবনের দাম বেশি। কিসের পাবলিক প্রেস্টিজ। ভালো ছাত্র হয়েও তুমি বছরের পর বছর সৎভাবে চেষ্টা করে কঠিন পরিশ্রম করে চাকরি পাওনি। আমি তো জানি। ঐ পাবলিক আমজনতা তোমাকে কি বেকারত্ব থেকে মুক্তি দিতে চেষ্টা করেছিল? ওদের কথা ছাড়ো। 

অনিল: সোমা আমি আসছি। অনেক রাত হয়ে গেল। আমাকে ভোরের লোকাল ধরতে হবে। সামান্য হকারি করে খাই।  তুমি বাড়ি ফিরবে তো? অনেক রাত হয়ে গেল তো।

সোমা: না ছোটকাকু। আমি বাড়িতে বলেছি আজ ছোটমাসির বাড়ি থাকবো। ছোটমাসির সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। অর্ণবের মেসেজ পেয়ে বুঝেছিলাম মারাত্মক কিছু হয়েছে। তাই মাসিকে ম্যানেজ করেছি। মাসি আমাদের রিলেশনশিপের ব্যাপারটা জানে। আমাকে বন্ধুর মত ভীষণ কোঅপারেট করে।

অনিল: ঠিক আছে। আমি তাহলে যাচ্ছি। তোমার ছোটকাকিমাও মনে হয় চিন্তা করছে। ও তো এসব কিছুই জানেনা। আমি একটা দরকারে দাদার কাছে এসেছিলাম। দেখলাম বাড়িটা থমথমে। বৌদি  আর অর্ণব ভীষণ চুপ করে আছে। দাদা কোথায় বলতে  বলল চিলেকোঠার ঘরে আছে। বুঝলাম কিছু সমস্যা হয়েছে। যাই হোক ভাগ্যিস চিলেকোঠার ঘরে গেলাম। আ্য একটু দেরী হলেই দাদাকে হারিয়ে ফেলতাম।

সুনীল: সেটা ভালোই হতো। কেন বাঁচালি আমাকে?

অনিল: বাজে বোকো না। 

(অর্ণবের বাবা ও মা দুজনেই হাউ হাউ করে কাঁদে)  কান্নাকাটি কোরোনা। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এবার সবাইকে বাঁচতে হবে। জীবন কি অত সস্তা। লড়াই করে বাঁচতে হবে। আমাকে দেখছ না? সারাদিন লড়াই করে বাঁচি। আর তোমাদের এত সুন্দর একটা বৌমা হচ্ছে। যে তোমাদের সবাইকে এত ভালোবাসে। এতো তোমাদের বিরাট সহায়। যাও বৌদি দাদাকে ঘরে নিয়ে যাও। চোখে চোখে রেখো। আর দাদা তুমি কাপুরুষের মত আর ওরকম নোংরা কাজ করতে যেও না। ছোট ভাই হলেও জ্ঞান দিয়ে বলছি।  মানুষের মতো বাঁচো। কাপুরুষরাই লড়াই না করে নিজেকে মেরে ফেলতে যায়। যাও। তোমরা ভেতরে যাও। (অর্ণবের বাবা ও মা ভেতরে চলে যায়)  আমি যাচ্ছি সোমা। যাচ্ছি অর্নব। মনের জোর বাড়া। রথীন দত্ত তোর কিছু করতে পারবে না। বাবারও বাবা আছে। আমি ঘরে গিয়ে জটাদাকে একটু পরে ফোন করে সব বলব। জটাদা যেরকমই লোক হোক আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি যাচ্ছি। সোমা এদের সবাইকে একটু দেখো।

সোমা: হ্যাঁ। ছোটকাকু। আমি আছি। চিন্তা করবেন না। আপনি আসুন। (অনিল বেরিয়ে যায়) 

সোমা: মন খারাপ করে থেকো না অর্ণব। 

অর্ণব: তুমি রাতে এ বাড়িতে রয়ে গেলে কেন? বাড়ির সবাই বাবা-মা কাকু কাকিমা তোমাকে যদি খারাপ ভাবে, তাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে। 

সোমা: আমাকে কেউ খারাপ ভাববে না। কেননা ওরা কেউ খারাপ নয়।  আর ওরা জানে আমিও খারাপ মেয়ে নয়। 

অর্ণব: কোথায় থাকবে রাতে?

সোমা: (হেসে) তোমার ঘরে। 

অর্ণব: তাহলে খারাপ ভাববেই।

সোমা: (হেসে) ভয় নেই। আমি চিলেকোঠার ঘরে একলা থাকব। 

অর্ণব: আবার ওখানে?

সোমা: (হেসে) ভয় নেই। মরব না। মরার কোনো ইচ্ছে নেই। বরং বাঁচার ইচ্ছে ভীষণ। তোমাকে নিয়ে। তোমার সঙ্গে। (সোমা দুহাত দিয়ে অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে গান গাইতে থাকে। অর্ণবের ক্রমশ চোখ ভিজে যায়।)

অর্ণব: (আবেগরুদ্ধ কন্ঠে)কেন এখনও আমাকে এত ভালোবাসছ তুমি? আমার মতো একজন অপদার্থ দুর্নীতিপরায়ণ ছেলেকে।

সোমা: নিজেকে গালাগালি দেবে না অর্ণব। একদম নয়।

অর্ণব: গালাগালিরই যোগ্য আমি। 

সোমা: আমি তা মনে করি না।

 অর্ণব: কী মনে করো?

সোমা: বললাম তো একটু আগে। তুমি সিস্টেমের শিকার। তুমি ভালো। শতকরা একশ ভাগ ভালো।

আমার চোখ ভুল দেখেনি। 

অর্ণব: কিন্তু আমি তো তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। 

সোমা: কীভাবে? 

অর্ণব: তোমাকে তো বলিনি দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আমি চাকরি পেয়েছি।‌

সোমা: কোন ছেলে কি এত সহজে তার প্রেমিকাকে এসব বলতে পারে?

অর্ণব:  আমি একজন কাওয়ার্ড। আমাকে তুমি ডিফেন্ড করছ?

সোমা: করছি। আমাদের বিয়ের পর তুমি নিশ্চয়ই সেটা বলতে।

 অর্ণব: তখন আমাকে ঘেন্না করতে না? 

সোমা: না। কারণ ওটাই। তুমি সিস্টেমের শিকার। আমি তো জানি তুমি ভালো ছাত্র। উন্নত সুস্থ রুচি আর মন তোমার। কেন তোমাকে কোনদিন ঘৃণা করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি অর্ণব। তোমার সমস্ত সত্তাকে। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে। কাটাছেঁড়া করে, ভুল ঠিক বিচার করে, দোষগুণ বিচার করে এই ভালোবাসার কোন ব্যাখ্যা করা যায় না।  আমরা কেউ  ত্রুটিমুক্ত নই পৃথিবীতে। ভুল ত্রুটি, দোষ গুণ - কোন কিছুই বিচার্য নয়। শুধু ভালোবাসাই বিচার্য। শুধু প্রেমই একমাত্র সত্য অর্ণব। কী হল অর্ণব? এত গুম হয়ে আছ কেন? দেখো এই প্রথম তোমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আমি রাত কাটাচ্ছি। আমার এই রাতটা ব্যর্থ করে দিও না।

অর্ণব: কেন তুমি আমার মত একটা মানুষের জন্যে  এত ভাবছ? কেন রয়ে গেলে এখানে? চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। 

সোমা: তাড়িয়ে দিচ্ছ আমাকে? 

অর্ণব: আমার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই। থাকবে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। 

সোমা: শুধু বাজে কথা। কিচ্ছু শেষ হয়নি। 

অর্ণব: হ্যাঁ সব শেষ হয়ে গেছে। আর যাদের জন্য শেষ হয়ে গেছে তাদের আমি ছাড়বো না। আমি চরম প্রতিশোধ নেব।  

সোমা: কী সব পাগলের মতো বলছ মাথা গরম করে?

অর্ণব: কিচ্ছু পাগলের মত নয়। আমি আবারও বলছি। আমি চরম প্রতিশোধ নেব। রথীন দত্তদের আমি ছাড়বো না।

সোমা:  কী সব বলছ! তুমি ওদের সঙ্গে আর লাগবে না। ওরা ভয়ংকর খারাপ। যা গেছে গেছে। যা হবার হয়ে গেছে। তুমি ওসব করতে গেলে তোমার বাকি জীবনটাও নষ্ট হয়ে যাবে অর্ণব। আমাদের বাঁচতে হবে। আমাদের সুন্দর করে  ভবিষ্যতের এক সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে হবে। 

অর্ণব: না তা আর হবে না। 

সোমা: কেন হবে না? আমি তো আছি তোমার সঙ্গে অর্ণব।

অর্ণব: আমাকে তুমি ভুলে যাও সোমা। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।

সোমা:  কী পাগলামি করছ?

অর্ণব: পাগলামি নয়।‌ আমি ঠিক বলছি।‌ আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে অসহায় কপর্দকশূন্য বাবার দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি জুটিয়ে ছিলাম। আমি অপদার্থ। দুর্নীতিপরায়ন। চোর। অবৈধ পথের পথিক। তুমি একটা সৎপরিশ্রমী মেধাবী ছাত্রী। পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতায় ব্যাংকে চাকরি পাওয়া একজন সম্মানীয়া মহিলা। আমার সঙ্গে -  আমার মতো দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে তোমার জীবন যুক্ত করে তোমার সম্মান নষ্ট কোরোনা। আমি অপদার্থ। সংসারের সর্বনাশ করলাম। নোংরা রাস্তায় চাকরি জুটিয়ে ছিলাম। তাই হাইকোর্টের অর্ডারে আমার চাকরি চলে গেল। সবাই জেনে গেল। সমাজে আমার সম্মান চলে গেল। আমার এই সম্মানহীন জীবনের সঙ্গে তোমার জীবন যুক্ত করে তোমাকে  অসম্মানিত করতে চাই না। 

সোমা: বার বার সেই একই কথা। সেই অপরাধবোধ। 

অর্ণব: হ্যাঁ অপরাধ বোধ। কারণ আমি অপরাধ করেছি। আমি অপরাধী। 

সোমা: আমি তো বার বার বলছি আমি তা মনে করিনা। কেননা আমার স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে সমাজ সচেতনতা দিয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিতে সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বলছি তো তুমি অপরাধী নও। আবার বলছি তুমি সিস্টেমের শিকার। কেন আমাকে একই কথা বলে বোর করছ?

অর্ণব: আমাকে নিতান্ত ভীষণ ভালোবাসো বলে আজ এই কথা বলছ। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে একদিন কিন্তু তুমি হয়ত অন্য কথা বলতে পারো। আমাদের সন্তানদের হয়ত বলতেই পারো তোর বাবা ছিল একটা করাপটেড দুর্নীতিগ্রস্ত চোর। দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে তারপর ধরা পড়ে চাকরি খোয়ানো একটা রাস্কেল জানোয়ার। বলতেই পারো ভবিষ্যতে  তাদের  - তাদের শুধু কেন – হয়ত আমাকেই একদিন বলতে পারো এইসব।

সোমা: তাই নাকি? এতদূর ভেবে ফেলেছ?  আমাকে এই চিনেছ? এত অবিশ্বাস আমাকে?

অর্ণব: হ্যাঁ। তাই। আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করি না। কোনকিছুই বিশ্বাস করি না। তাই? 

সোমা: তাহলে সত্যি আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। অবিশ্বাস দিয়ে আমিও জীবন শুরু করতে চাই না। (বাষ্পারুদ্ধ কণ্ঠে) ঠিক আছে অর্ণব। তোমাকে মুক্তি দিলাম। আমি চলে যাচ্ছি। (প্রচন্ডভাবে কেঁদে ফেলে) 

অর্ণব: দাঁড়াও। এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?

সোমা:  নিজের বাড়িতে‌। লাস্ট বাস পেয়ে যাব। 

অর্ণব: আমি পৌঁছে দেব?

সোমা: না। (চলে যায়)


।। দ্বিতীয় দৃশ্য।।

(থানা। ওসির চেম্বার।)

অর্ণব: বলুন অফিসার আমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন। 

ওসি: আপনি বুঝতে পারছেন না নাকি ন্যাকার মতো বুঝেও না বোঝার ভান করছেন?

অর্ণব: আমি নিশ্চয় অনেক কিছু আন্দাজ করছি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই আমার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ কী। 

ওসি: আপনি লিফলেট ছাপিয়ে  চতু্র্দিকে সেগুলো ছড়িয়ে এলাকার কিছু সম্মানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে তাদের সম্মান নষ্ট করছেন। 

অর্ণব: সম্মানীয় নেতা? হাসালেন। হ্যাঁ। করছি। কারণ সেটাই তাদের প্রাপ্য। দরকার হলে ওরা আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুক। এসবে আপনার সমস্যা কিসের?

 ওসি: আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছেন?

 অর্ণব: না কৈফিয়ত চাইছি না।  শুধু জানতে চাইছি কারণটা। 

ওসি: আপনার কথা কে শুনবে? কে বিশ্বাস করবে? আপনি তো চাকরির পরীক্ষায় ফেল করে তারপর দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি জুটিয়েছেন আর তারপর ধরা পড়ে গিয়ে হাইকোর্টের অর্ডারে  আপনার চাকরি খুইয়েছেন।

অর্ণব: ঠিক। একদম ঠিক বলেছেন।  আমি তো লিফলেটে এই সমস্ত কথাই লিখেছি।

ওসি: কিন্তু লিফলেটে যাদের নামে আপনি অভিযোগ করেছেন, তারা নির্দোষ সম্মানীয় নেতা। 

অর্ণব: তাই নাকি? 

ওসি: আপনি প্রমাণ করতে পারবেন তারা আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?

অর্ণব:  না। পারবো না। আমি অভিযোগ করছি। তদন্ত করার কর্তব্য আপনাদের। রথীন দত্ত আর আমার বাবার কল লিস্ট চেক করে রথীন দত্তকে জিজ্ঞেস করুন কী এত কথাবার্তা হয়েছিল ওর সঙ্গে আমার বাবার। আপনারা ওকে পেঁদিয়ে ওর স্বীকারোক্তি আদায় করুন। 

ওসি: আপনার কথায়?

অর্ণব: হ্যাঁ। আমার কথায়। আমি তো বলছি  ওদের দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছি। 

ওসি: আপনি মিথ্যেকথা বলছেন। 

অর্ণব: তাহলে আমার চাকরি গেল কেন? আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করতেও আমার চাকরি হলো কেন?

ওসি: আপনি ঘুষ দিয়েছেন। তাই হয়েছে।

 অর্ণব: হ্যাঁ। বলছি তো দিয়েছি। ভূতকে তো ঘুষ দিইনি। আমরা সেই সব ক্ষমতাবানদের ঘুষ দিয়েছি যারা আমি চাকরির পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও  আমাকে চাকরি তে ঢুকিয়েছিল। তারা কারা?

ওসি: সে আমি কি করে জানব আপনি কাদের ঘুষ দিয়েছেন? সেটা তো আপনি জানেন।

অর্ণব: জানি তো। তাদের নামই তো লিফলেটে লিখেছি। তাদের অ্যারেস্ট করে ইনটারোগেট করুন। 

ওসি: আপনার কথায়?

অর্ণব: হ্যাঁ। আমার অভিযোগের ভিত্তিতে। 

ওসি: আপনি নির্দোষ লোকদের নামে মিথ্যে অভিযোগ করছেন তাদের ফাঁসাবার জন্য। আসল অপরাধীদের আড়াল করতে। 

অর্ণব: আমার মোটিভ?  

ওসি: আপনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এই কাজ করছেন। এটাই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।

 অর্ণব: আপনার কথার প্রমাণ?

ওসি:  কোনো প্রমাণ বা কৈফিয়ত আপনাকে দেব না। আপনি আজকেই আবার একটা লিফলেট ছাপিয়ে সেখানে লিখবেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় আপনি সম্মানীয় নেতাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।

 অর্ণব: তাই নাকি? আমাকে এতই  ভেড়া আর রামছাগল মনে করেন? আমার তো সব গেছে। টাকা কড়ি চাকরি সম্মান। আমার আর হারাবার কিছু নেই। ভয়েরও কিছু নেই। শুনুন অফিসার। আমি আর কোন লিফলেট ছাপাবো না। যেটা ছাপিয়েছি, সেটাই বরং আরো অনেক জেরক্স করে সব  জায়গায় বিলি করব। আর রাস্তাঘাটে বাজারে মোড়ে সর্বত্র মাইক ভাড়া করে আপনাদের ওই সম্মানীয় নেতাদের মুখোশ খুলে দেব। ওদের বলবেন আমি ওদের ছাড়বো না। 

ওসি: আপনাকে অ্যারেস্ট করব। 

অর্ণব: করুন। তারপর জামিন নিয়ে বেরিয়ে আবার একই কাজ ক্রমাগত করে চলব। আপনাদের ওই ঘুষখোর সম্মানীয় নেতাদের সম্মানটা ধুলোয় মিশিয়ে দেব। যেভাবে আমার সম্মান ওরা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। 

ওসি: আপনি বেরিয়ে যান। আ আর এক মিনিট থাকলে আপনাকে লকআপে পুরব। 

অর্ণব: যাচ্ছি। এখানে এক সেকেণ্ডও থাকার ইচ্ছে নেই। আপনি ডেকেছিলেন। তাই এসেছিলাম।  

 (সেই মুহূর্তে মৌসুমী, তাপস ও প্রশান্ত বাইরে থেকে এসে ওসির ঘরে ঢুকে পরে।।)

মৌসুমীঃ দাঁড়াও অর্ণব। তুমি যাবে না। আমরা বাইরে থেকে সব শুনেছি।

ওসি:  কী ব্যাপার? আপনারা বিনা পারমিশনে ওসির ঘরে ঢুকলেন কেন?

তাপসঃ বেশ করেছি। রথীন দত্ত ঢুকলে এটা বলতেন?

ওসি: এই তাপস! বড় ফুটবলার হয়ে গেছ? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।

 প্রশান্তঃ তার আগে বলুন আমাদের কি অপরাধ? অর্ণবদার মতো  একইরকমভাবে রথীন দত্ত  স্কুলে চাকরি দেওয়ার নাম করে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছে। আর কোর্টের অর্ডারে ওর মতো আমারও চাকরি চলে গেছে।

তাপসঃ  রথীন দত্ত আমার কাছ থেকেও  দশ লাখ টাকা নিয়েছে। আমারও চাকরি চলে গেছে কোর্টের অর্ডারে।

 মৌসুমীঃ  আমরাও বাড়ি থেকে রথীন দত্তকে দশ লাখ টাকা দিয়েছি আমার ছোট ভাই তপনের চাকরির জন্যে।ওরও চাকরি চলে গেছে কোর্টের অর্ডারে। 

ওসি: কোর্টে যান। কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করুন। আমার কাছে এসেছেন কেন?

তাপসঃ আপনি কি জানেন আমার বাবা জমি বেচে টাকা দিয়েছে রথীন দত্তকে?

প্রশান্তঃ আপনি কি জানেন আমি মায়ের  গয়না বেচে টাকা দিয়েছি রথীন দত্তকে?

মৌসুমীঃ আপনি কি জানেন আমার ভায়ের চাকরি চলে যেতে ও কাউকে কিছু না বলে গতকাল পাগলের মত বাড়ি থেকে চলে গেছে? শুধু রথীন দত্ত নয়। রথীন দত্ত বরফের চূড়ো। অনেক রাঘব বোয়াল পেছনে আছে।

ওসি: ওসব ফালতু কথা আমাকে বলতে এসেছেন কেন?

তাপসঃ ফালতু কথা? আপনি সব জানেন।

প্রশান্তঃ ওই কয়েকটা লোকের জন্য আমাদের সকলের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

ওসি:  তোমরা আমাকে বলছ কেন?

মৌসুমীঃ   কাকে বলব? আপনি তো এলাকার ওসি। ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি।

 ওসি: বললাম তো। কোর্টে গিয়ে অভিযোগ করুন। এটা কোর্ট নয়।

 মৌসুমীঃ কোর্টে যাবার পয়সা কে দেবে? আপনি? আমরা অভিযোগ করছি রথীন দত্তর নামে। আপনি স্টেপ নিন।

তাপসঃ হ্যাঁ। রথীন দত্তর বিরুদ্ধে আমরা ডায়েরি করব। 

ওসি: (হেসে) রথীন দত্তর বিরুদ্ধে আমরা ডায়েরি করবে?

প্রশান্তঃ হ্যাঁ। আর আপনাকে  ডায়েরি নিতে হবে।

মৌসুমীঃ আর ওকে অ্যারেস্ট করতে হবে।

ওসি: (হেসে) তাই নাকি?

মৌসুমীঃ হ্যাঁ। তাই।

অর্নবঃ আর তা যদি না করেন, আমরা গণআদালত করে ওর বিচার করব।

ওসি: (হেসে) তাই নাকি? এতবড় নেতা হয়ে গেছ? এরকম বেআইনি কাজ করলে আমরা কী করব জানো?

তাপসঃ হ্যাঁ।  আইন দেখিয়ে আমাদের অ্যারেস্ট করবেন। কিন্তু ঐসব চোরেদের চিটিংবাজির ব্যাপারে আপনাদের আইন চুপ করে থাকে।

(রথীন দত্তর প্রবেশ)

রথীন দত্ত: কী ব্যাপার অফিসার?

ওসি: (হেসে)এরা আপনাদের বিরুদ্ধে ডায়েরি করতে এসেছে।

রথীন দত্ত: তাই নাকি?

ওসি: (হেসে) আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বলছে।

রথীন দত্ত: আচ্ছা?

ওসি: (হেসে) বলছে গণআদালতে আপনার বিচার করবে।

রথীন দত্ত: পিটিয়ে বের করে দিন থানা থেকে।

ওসি: ঠিক। সেটাই করতে হবে। বহুৎ বাড়াবাড়ি করছে।

অর্ণব: (চিৎকার করে) দিন। পিটিয়ে বের করে দিন আমাদের থানা থেকে। কিন্তু আমাদের মুভমেন্ট থামবে না। প্রতিদিন বেড়ে চলবে। প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়বে। আর আপনাদের নেতাদের চামচাবাজি করার মুখোশ টেনে খুলে ফেলবে।

ওসি: (পুলিশদের ডাকে) এই! এদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।

(দুজন পুলিশ ওদের ধাক্কা দিয়ে বার করতে থাকে। ওরা বেরোবার সময় প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদী চিৎকার করতে থাকে।)


।। তৃতীয় দৃশ্য।।

(অর্ণদের বাড়ি। রাতের বেলা। কলিং বেল।‌ অর্ণবের বাবা দরজা খুলে দেন।‌ একজন সাবইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ ঢুকে পরে।)

সাবইন্সপেক্টর: কোথায় আপনার ছেলে? তাকে ডাকুন।

সুনীল: কেন?

 সাবইন্সপেক্টর: আমরা ওকে থানায় নিয়ে যাব। 

সুনীল: এত রাতে কেন ওকে থানায় গিয়ে যাবেন?

সাবইন্সপেক্টর: সেই কৈফিয়ত আপনাকে দেব না। 

সুনীল: আপনাদের কাছে ওর কোন নামে কোন আরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?

 সাবইন্সপেক্টর: আপনাকে কোন জবাবদিহি করব না।‌ ওকে ডাকুন। 

সুনীল: ও ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ঘুমোচ্ছে। 

সাবইন্সপেক্টর: (পুলিশদের)এই তোমরা ছাদে গিয়ে ওকে নীচে নামিয়ে নিয়ে এসো। (পুলিশদের কানে কানে কিছু বলে। পুলিশদুটো ওপরে চলে যায়।)_

সুনীল:একি! আপনারা আমার বিনা পারমিশনে ওপরে গেলেন কেন? আপনাদের কি কোন সার্চ ওয়ারেন্ট আছে? (অর্ণবের মা তপতী ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে)

তপতী:  কী হয়েছে? পুলিশ কেন?

সুনীল: অর্ণবকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। 

তপতী:  কেন? কী করেছে আমার ছেলে? আমার ছেলেকে কোথাও নিয়ে যাবেন না।

সুনীল: ওরা অলরেডি আমাদের ছাদের ঘরে চলে গেছে অর্ণবকে ধরতে।

তপতী: না আমার ছেলেকে ধরবেন না। আপনারা এসব করতে পারেন না। 

সাবইন্সপেক্টর: চোপ। আর একটা কথা বললে আপনাদের দুজনকেও তুলে নিয়ে যাব। 

সুনীল: মানে? জোর যার মুল্লুক তার। গাজুয়ারি পেয়েছেন। রাত দশটার সময় বাড়িতে এসে বিনা ওয়ারেন্টে আমাদের সবাইকে তুলে নিয়ে যাবেন?

সাবইন্সপেক্টর: হ্যাঁ। যাব। 

সুনীল: আপনারা এসব করতে পারেন না।

সাবইন্সপেক্টর: চোপ। একটা কথা বলবেন না। 

সনীলঃ রাতের বেলায় ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকে মাস্তানি করছেন পুলিশ  অফিসার হয়েছেন বলে? দেশে আইন নেই? বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে। 

সাবইন্সপেক্টর: চোপ। পুলিশ অফিসারকে বেরিয়ে যেতে বলছে! এত স্পর্ধা! 

সুনীল: হ্যাঁ বলছি। ঐ পুলিশ দুটোকে নিয়ে এই মুহূর্তে আমর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আপনাদের কাছে কোন ওয়ারেন্ট নেই। বেআইনিভাবে ঢুকে মাস্তানি করছেন।

( সাবইন্সপেক্টর  অর্নবের বাবাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়)

তপতী: একি! আমার স্বামীকে মারলেন কেন? কেন মারলেন? কেন মারলেন? (তপতী চিৎকার করতে থাকেন।  এই সময়  পুলিশ দুটো নেমে আসে।)

প্রথম পুলিশঃ স্যার কাজ হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় পুলিশঃ কমপ্লিট।

সাবইন্সপেক্টর:  কী ব্যাপার? 

(একজন পুলিশ সাবইন্সপেক্টর কে কানে কানে কিছু বলে)

সাবইন্সপেক্টর  শুনুন সুনীল বাবু। আপনার ছেলেকে পুলিশরা ধরতে গেছিল। ও পুলিশের হাত ছাড়িয়ে  তিনতলার ছাদ থেকে রাস্তায় লাফ দিয়ে পালাতে গেছিল। এখন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এই তোমরা চলো।

(অর্ণবের বাবা ও মা প্রচণ্ড আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাইরে থেকে অনিল দৌড়ে ঢোকে।)

অনিল:  দাদা, এরা অনুকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখনি চলো। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

সাবইন্সপেক্টর: কে বলল ওকে আমরা  ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি?

অনিল: (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) আমার জানলা থেকে আমি নিজের চোখে  দেখেছি। 

সাবইন্সপেক্টর:  আপনি ভুল দেখেছেন। 

প্রথম পুলিশঃ হ্যাঁ। আপনি ভুল দেখেছেন।

 দ্বিতীয় পুলিশঃ ও আমাদের তাড়া খেয়ে  পালাতে গিয়ে নিজেই লাফ দিয়েছে।

 অনিল: (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) না। আপনারা মিথ্যে বলছেন। আমি  নিজে দেখেছি ওকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।

সাবইন্সপেক্টর: (প্রচণ্ড ধমকে)  আপনি ভুল দেখেছেন। এই তোমরা চলো।

অনিল: ওকে আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যান। 

 সাবইন্সপেক্টর: আপনারাা নিয়ে যান। লাফ দিয়েছে ও। আমরা ওকে লাফাতে বলিনি। এই চলো। (বেরিয়ে যায়।

অনিল: দাদা! বৌদি,!এখনি চলো। এভাবে ভেঙে পোড়োনা। অনুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালে  গেলে হয়ত অনু বাঁচতে পারে।কী করছ দাদা? ওঠো ওঠো। (প্রচণ্ড আকূতি করে চিৎকার করে) ওঠো ওঠো।ওঠো…………………….

                         (প্রচণ্ড আবহ। অন্ধকার।)

(অন্ধকার মঞ্চে অতি ক্ষুদ্র আলোকবৃত্তে উদ্ভাসিত হয় অর্ণবের মুখ)

অর্ণব: আমারতো মৃত্যু হল।‌ এরপর কী কী ঘটবে আমি বলে দিতে পারি। বিভিন্ন  রাজনৈতিক দল হইচই করবে। একদল বলবে দুর্ঘটনা। অন্যরা বলবে হত্যা। ময়নাতদন্ত বলবে দুর্ঘটনা। বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ আন্দোলন বিক্ষোভ মিছিল হতে থাকবে। আমার মুমূর্ষু শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবা মাকে মিডিয়ার লোকরা এসে নিয়মিত বিরক্ত করে যাবে। বাবা-মা- কাকার মুখ বন্ধ করার জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া ও প্রলোভন দেখানো চলবে। বুদ্ধিজীবীদের মোমবাতিগুলো নেভানোই থাকবে। তারপর মানুষেরা কমবেশি ফ্রী লজেন্স  পেতে পেতে ধীরে ধীরে  সব ভুলে যাবে। একটা ছোট্ট শহীদ বেদী হয়ত হবে। সেটাও আসতে আসতে ময়লা হয়ে যাবে। এইভাবে  দিন মাস বছর গুলো গড়িয়ে একদিন ভোট এসে যাবে। শপথগ্রহণ হবে। তারপর কোনদিন আবার কোন অর্ণব হয়ত পুলিশের তাড়া খেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরবে বা তাকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আপনাকে বলা হবে আপনি ভুল দেখেছেন, ভুল শুনেছেন, ভুল বুঝেছেন। 

 (নাটকটি প্রযোজনার অনুমতির জন্য যোগাযোগঃ 8910019589)




আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933